মঙ্গলবার, ২৪ আগস্ট, ২০১০

ছোটকাগজ: আশি, নব্বই এবং শূন্যের সম্ভাবনা (পরিমার্জিত) / মাহমুদ সীমান্ত


সাকুল্যে ছোটকাগজ
সাহিত্যের একটি ধারণামাত্র। সাহিত্য প্রকাশনায় এটি একটি বিকল্প মাধ্যমব্যতীত বিশেষ কোনকিছু নয়। ভুল কর্ম সম্পাদনে কখনো কখনো তা ছোট আকৃতির কাগজও বটে। ছোট ছোট প্রেক্ষাপট থেকে ছোট ছোট অনুষঙ্গ নিয়েই ছোটকাগজের উদ্ভাবনা। সমস্যা, সম্ভাবনা নিয়েই যা আমাদের দেশেও এ ধারণার সাহিত্য প্রকাশনার প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে ছোটকাগজ প্রকাশনা আজ যতটা প্রসারিত- ধরা যায়, বিগত বছর ত্রিশেক পূর্বে ততটা হিরিক ছিলো না। এই সময়ে কম করে হলেও একশটি ম্যাগাজিন সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয়। বছর ত্রিশেক পূর্বে, তখনকার ছোটকাগজ কর্মীরা এরকম করে ভাবতেই পারেননি- ভাবতেই পারেননি বলতে তখনকার সময় ছোটকাগজ প্রকাশনায় এত সুযোগ কিংবা এত কর্মীও ছিলো না। আজকের ছোটকাগজ প্রকাশনার এই প্লাটফর্মটি মূলত সেই দুর্যোগের সময় থেকেই তৈরি হয়েছে। সমগ্র একটা বিপর্যস্ত দেশ, প্রতিষ্ঠানগুলির বিমুখতা এইসব সমস্যাবলির মুখোমুখি হয়েই তখনকার কর্মীদের ছোটকাগজ বিষয়টি ভাবতে হয়েছিলো। ফলে তাঁদের যে যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় এগুতে হয়েছিলো এই সময়ের একজন কর্মীর সামনে তেমন কোনো সমস্যাই জড়িত নয়। বলা যায়, পূর্ববর্তীদের তৈরি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েই এই সময়ের কর্মীরা স্বাচ্ছন্দে কাজ করে যাচ্ছেন। এটা অবশ্য পূর্ববর্তী সময়ের সাথে তুলনা সাপেক্ষ কিন্তু সার্বিকভাবে ছোটকাগজ কর্মীরা যে, স্বাচ্ছন্দ ভোগ করছেন তা নয়।
ছোটকাগজ কর্মীদের অধিকাংশই থাকেন তরুণ, অখ্যাত, অর্থহীন অথচ প্রবল প্রাণশক্তিসম্পন্ন ফলে বছর বছর ছোটকাগজ প্রকাশনাও বেড়ে চলেছে সারাদেশে। আসছে নতুন কর্মী। যদিও কোন কোন কর্মী বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রাণশক্তিহীন হয়ে এ পথ ছেড়ে দেন। তাঁর উক্ত অভাব পূরণের জন্য কোন না কোন নতুন কর্মী এগিয়ে আসেন। পূর্ববর্তী সময়ের বহু ছোটকাগজ প্রকাশনা আজ বন্ধ হয়ে গেছে, বহুবিদ অসহযোগিতা আর সমস্যার একঘেয়েমিই এর কারণ। ‘সিসটেমিটি দি সারভাইবাল ওয়ার্ক বাই প্রটোকল’ এটিও একটি কারণ আবার কখনো কখনো লেখকদের বিচ্ছিন্নতাই প্রধান কারণ হয়েছে। এরকম অনেক উদ্ভট পরিস্থিতি থেকেই আবার কোনো কোনো কাগজ আত্মপ্রকাশও করতে পারে না, সমাপ্তি ঘটে যায় পরিকল্পনাতেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন গোষ্ঠিবদ্ধতার ধারণাটি পরিস্কার হয়ে ওঠে না ফলে এ জায়গায়ও ছোটকাগজের ভিত্তিভূমিটি পতিত থেকে যায়। অবশ্য আরও একটি বড় সমস্যা হলো সরকারিভাবে ছোটকাগজের উপর সহযোগিতা প্রদানের অভাব। একথা সত্য যে, বাংলাদেশে ছোটকাগজ প্রকাশনা আজ যতটা প্রসারিত তারচেয়েও বহুগুণ প্রসারিত হতে পারতো যদি তাতে সরকারি/বেসরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা থাকতো। আমাদের ছোটকাগজকে ঘিরে যেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারাই ছোটকাগজ প্রকাশনা গতিকে আরও ব্যাপকভাবে করে দিতে পারেন, নিজেদের প্রকাশনার বিজ্ঞাপন দিয়ে। তাতে যেমন ছোটকাগজের অল্পবিস্তর অর্থের সমৃদ্ধি আসতো আর নতুন নতুন উতসাহী কর্মীও পাওয়া যেতো। আবার নিজেদের প্রকাশনাগুলো যেমন ব্যাপক পাঠকের হাতে পৌঁছানো সম্ভব ছিলো, ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিও অর্জিত হতো পাশাপাশি ছোটকাগজ প্রকাশনাগতিও ধরে রাখা সম্ভব ছিলো। কিন্তু আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলির এরকম যথেষ্ট উন্নাসিকতার কারণে বিভিন্ন প্রকাশকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তেমনই ছোটকাগজের ব্যাপক প্রকাশনাগুলি পিছিয়ে যাচ্ছে আরো বেশি।
শুধু এটাই নয় আরো ভাবা যেতে পারে। এখন তো ছোটকাগজগুলির সংঘবদ্ধ হওয়ার মতো ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় ছোটকাগজের বিক্রিও নিশ্চিত হয়েছে। আমি জানি, সেটা আমার হাত দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সার্বিক ছোটকাগজের আর্থ-সামাজিক বা নিকট ভবিষ্যতের অবস্থার কথা চিন্তা করলে দেখা যায় সময়ের প্রেক্ষাপটে তা আসলে কিছুই নয়। ছোটকাগজের সকল প্রকাশনাই যে অত্যন্ত সিরিয়াস কিছু তা অবশ্য নয়। সকল ছোটকাগজ যুক্তিসংগতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে না কোন কোন কাগজ যুক্তিসংগতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে এক কাগজের সৃষ্ট জটিলতা অন্য কাগজের উপর গিয়ে পড়ছে। অন্যদিকে ছোটকাগজের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কতিপয় লেখক-কবি তাদের নতুন লেখনিটি আত্মবিশ্বাসের সাথেই ছোটকাগজে মুদ্রিত করে থাকেন। যখন তার লেখাটি বিশেষ কোন আলোচনা বা সমালোচনায় চলে আসে তার গুণাগুণ যেমন লেখকস্বত্তাটির উপর পড়ে থাকে তেমনই এর কৃতিত্ব চলে আসে ছোটকাগজের উপরেও। তথ্য-প্রযুক্তির এসময়ে নব্য নব্য ধারণার যেমন প্রতিফলন সম্ভব তেমনি সম্ভব সুদূর সাহিত্যের উজ্জ্বল চিত্রটি আমাদের প্রান্তিক পাঠকশ্রেণিকেও জানিয়ে দেয়া। পিছিয়ে পড়া এ অংশটি আরেকটু সক্রিয় ভূমিকায় নিয়ে আসতে ছোটকাগজের কর্মীদের উচিত পরাক্রম সংঘবদ্ধতায় সম্মিলিত হওয়া।
স্বাধিনতা পরবর্তী বাংলাদেশে যেসব ছোটকাগজ প্রকাশিত হয় তার মধ্যে আশির দশকে প্রকাশিত কাগজগুলোই আজও আমাদের কাছে সর্বাগ্রে গৃহীত হচ্ছে তাদের যথার্থ কাজের জন্যে। পুরো নব্বই দশকে আমার চোখে পড়েনি এমন একটি ছোটকাগজের উত্তরণ যা আশির দশকের সেইসব কাগজের সংগে তুলনা করতে পারি। আশির দশকে কিছু উল্লেখযোগ্য কাগজ হলো গাণ্ডীব, প্রসূণ, সংবেদ, কিছুধ্বনি, রূপম, পেঁচা, প্রান্ত, নিসর্গ, লিরিক, অনিন্দ্য, একবিংশ, নদী, প্রতিশিল্প, দ্রষ্টব্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য, সৃজনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমি পত্রিকা, কালধারা, দ্বিতীয় চিন্তা, লোকায়ত ইত্যাদি। এছাড়া আরও দু’একটি কাগজ অনায়াসে বের করা সম্ভব কিন্তু পুরো নব্বই দশকে সে রকম কোন ছোটকাগজ কি বের করা সম্ভব? এই লেখাকে একটি দশকের প্রতিপক্ষ অর্থে বিবেচনা না করে সত্যিকার ছোটকাগজের প্রেক্ষাপটটি বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে।
আশির দশকে ছোটকাগজ ঘিরে কিছু সংখ্যক উল্লেখযোগ্য লেখক বেরিয়ে এসেছেন যাদের মধ্যে এখনও কেউ একেবারেই ছোটকাগজে লিখে চলেছেন আবার কেউ কেউ ছোটকাগজের পাশাপাশি অন্যান্য প্রকাশনায়ও লিখে যাচ্ছেন। সেলিম মোরশেদ, সাজ্জাদ শরিফ, তপন বড়ুয়া, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, পারভেজ হোসেন, শোয়েব শাদাব, কাজল শাহনেওয়াজ, বিষ্ণু বিশ্বাস, আহমেদ মুজিব, ফরিদ কবির, সৈয়দ নাজমুল করিম, কফিল আহমেদ, রিফাত চৌধুরী, শান্তনু চৌধুরী, কামরুল হাসান, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, মঈন চৌধুরী, মাসুদ খান, সরকার মাসুদ, সাদ কামালী, জুয়েল মাজহার, বদরুল হায়দার, কামরুল হুদা পথিক, ফেরদৌস নাহার, আবু হাসান শাহরিয়ার, খালেদ হামিদী, শামীম আজাদ, সঞ্জিব চৌধুরী, সরকার আশরাফ, সুহিতা সুলতানা, শিহাব শাহরিয়ার, সাইমুম রাজু, সৈয়দ তারিক, ইমতিয়ার শামীম, স্বদেশ বন্ধু সরকার, শামসুল কবির, আহমেদুল বারী, নুরুন্নাহার শিরীন, ইয়াসিনুর রহমান, খালেদ হোসাইন এইসব লেখককুলই মূলত আশির দশকের প্রধান লিখিয়ে। এঁরা সকলেই আশির ছোটকাগজের লেখক হিসেবে অগ্রগণ্য। যদিও ছোটকাগজের প্রচল ধারণায় টিকে থাকেননি অনেকেই তবু অধিকাংশের প্রভাববিস্তার এখনো ছোটকাগজে বহাল রয়েছে।
বাংলাদেশে স্বাধিনতাযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালটা কখনোই প্রকৃত সাহিত্যের জন্যে মঙ্গলজনক অধ্যায় বলে বিবেচনা করা যায় না। দেশের এরকম বিপর্যয়ের পর সত্তর দশকের লেখককুলসহ পূর্ববর্তী সময়ের কিছু কিছু লেখক একপেঁষেভাবে বিপর্যয় তথা স্বাধিনতাগীতি, রাজনৈতিক শ্লোগানচারিতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন ফলে কবিতা কিংবা গদ্য সাহিত্যে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ায় আশির দশকের লেখকদের একটু ভিন্নভাবেই ভাবতে হয়েছিলো সাহিত্যের নানা বাঁক বা দিকভাষ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে। উত্তাল, উদ্দাম সময়টা ছিল এরকমই। যখন শিরার টানে রক্ত উত্তপ্ত হয়ে ফেনিল, উপচে পড়তে পারে। পূর্ববর্তী লেখককুলের আশ্রয়হীনতা, সরকারি অসহযোগিতা, গ্লোবালাইজেশন, প্রকৃত সাহিত্য উদঘাটন, সাহিত্যকে নতুন করে ভাবা, নতুন কিছু সৃষ্টি করার উদ্যোমি মানসিকতা, নতুনের গুরুত্ব তৈরি করা এইসব কারণেই মূলত তাঁদের নতুন একটা প্লাটফর্ম- ছোটকাগজ, অত্যন্ত জোরালোভাবে ভাবতে হয়েছিলো সাহিত্যেও। এটাকে একটা বড় ধরনের আন্দোলন বা নির্দিষ্ট একটা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মতো বড় ধরনের প্রবণতা বলা যেতে পারে। ভিত্তিভূমিটি যে সক্রিয়ভাবেই জোড়ালো হয়েছিলো সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। অগ্রবর্তীদের দ্বিধা-দ্বৈততা তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন, যে কারণে বিষয়টি তাদের মধ্যে আর সমস্যা আক্রান্ততায় স্থবির থাকেনি। ছোটকাগজের গোষ্ঠিবদ্ধতায় নিজেদের লেখালেখির চর্চা চালিয়েও তেমন কোনো বিতর্ক বা সমালোচনায় তাঁদের পড়তে হয়নি। এটা তাঁরা নিজেদের সমন্বিত মহিমাগুণেই করতে পেরেছিলেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আজও অটুট আছে, এই সময় যে প্রাপ্তি বা প্রত্যাশায় বিশেষ কোনো ফলযোগ হবে না ততধিক হতাশার উদ্রেক ছাড়া।
ইদানিং ছোটকাগজ নিয়ে বাংলাদেশে নানা ধরনের তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ছোট্ট এই মুভমেন্টটিও হুমকিসরূপ দেখছেন অনেকেই। কেউ কেউ ছোটকাগজ প্রকাশনাটাকে ভাবছেন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অন্যতম পথ, কেউ কেউ ভাবছেন দৈনিকের সাহিত্য পাতার প্রতিপক্ষ, কেউ কেউ ভাবছেন নিজেদের এক্সট্রা গুরুত্ব তৈরি করার প্রধান পথ, কেউ কেউ ভাবছেন নতুন লেখক বা যাদের লেখা কোথাও ছাপাবার উপযুক্ত নয় তারাই শেষমেশ ছোটকাগজ-কে আঁকড়ে ধরে জীবন রা করার প্রধানতম প্লাটফর্ম করে নিচ্ছেন, জীবন-জীবিকায় সামান্যতম অর্থযোগের ব্যবসায়িক প্রবণতাটিও বাদ যাচ্ছে না। যে যাই বলুন না কেন, সাহিত্যচিন্তায় আমাদের বর্তমান বঙ্গদেশে এমন কোন প্রতিষ্ঠান, এমন কোন দৈনিক নেই যাকে প্রতিপক্ষ ভেবে এই ভূ-খণ্ডে সাহিত্য আন্দোলনের নামে ছোটকাগজ প্রকাশনা হতে পারে। যারা এই বিষয়গুলো কেন্দ্র করে ছোটকাগজের শ্লোগান তোলেন তারাই শেষপর্যন্ত সত্ ছোটকাগজ কর্মী হয়ে ওঠেন না বরং ছোটকাগজ কথাটির মধ্যে অন্য কিছু লুকিয়ে রয়েছে। যে নামটি শুনলেই মনে হতে পারে সত যুক্তিসংগত-সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু কোনো, যেখান থেকে যে কেউ নির্দ্বিধায় তন্ময় হতে পারেন। আর বাদবাকি- বাজারে যেসব ধারণার প্রচলন করা হয় তাদের অনেকেই পাশ্চাত্যের ধারণা বা পশ্চিমবঙ্গের ছোটকাগজ আন্দোলনের মতাদর্শ নিয়ে হৈচৈ করে নিজেদের স্বকিয়তা হারাচ্ছেন। তাছাড়া ছোটকাগজও তো একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। দ্বিমত হবার সুযোগ নেই। আমি বিশ্বাস করি, যুক্তিসংগত এবং সত সাহিত্যের চর্চার পাশাপাশি নতুন লেখকদের সাহিত্যিক প্রবণতায় দাঁড়াবার একটা নির্দিষ্ট জায়গা করে দেয়া এবং নির্দিষ্ট একটা গোষ্ঠি তৈরি করা, যাতে অসত এবং অযৌক্তিক সাহিত্যের দিকে কেউ যেতে না শিখে। আর ঐ নির্দিষ্ট কাগজটি যা নিজেদের ভাবনাগুলি স্বকিয়তার সাথে গুরুত্ব প্রদান করবে, নিজেদের আরো গুরুত্বের দিকে ধাবিত করার প্রেরণা যোগাবে। সম্প্র্রতি ছোটকাগজের এই গুণটি বর্ধিত হতে চলেছে। সুষ্ঠু বিপণনের প্রত্যাশায় অমর একুশে বইমেলায় এখন লিটল ম্যাগাজিন চত্বরও দেয়া হয়ে থাকে। এর আগে আমরা দেখেছি, খোলা আকাশের নিচে বয়ড়াতলায় ছোটকাগজ কর্মীদের সেকি দুর্ভোগ! অথচ এই ছোটকাগজ করতে গিয়ে কোনো কোনো সম্পাদক/প্রকাশক নিজেদের রক্তও বিক্রি করেছেন ব্লাডব্যাংকে। সেটি সফল হয়েছে, কিন্তু ছোটকাগজের প্রকৃত সাহিত্য প্রবণতা কি আইডেন্টিফাইড হয়েছে? ছোটকাগজের প্রকৃত কর্মী হিসেবে আমরা যাদের জেনেছি তাদেরই কেউ কেউ ছোটকাগজের প্লাটফর্মটি ব্যবহার করে অন্য অভিধায় উচ্চ শিখরে অবস্থান করেছেন। যুক্তি থাকতে পারে, চেতনার কোনো পরিবর্তন সেখানে হয়নি। কিন্তু মৌলদৃষ্টিতে সার্বিক ছোটকাগজের ক্ষতিই হয়েছে।
নব্বই দশকে যদিও সেরকম কোন উল্লেখযোগ্য ছোটকাগজ খুঁজে পাওয়া যায় না, তবুও আশির দশকের ছোটকাগজ আন্দোলনের প্রভাব পুরোপুরি নব্বই দশকেই বিস্তারিত হয়। নতুন উদ্যোমি আরও লেখক-কর্মী এসে বিষয়টি আরো সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যান কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই দশকের নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য না থাকায় এই সময়ের লেখক-কবিকুল বিচ্ছিন্নভাবে অনেক পথেই হেঁটেছেন এবং হাঁটছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমি বলবো, নব্বইয়ে ছোটকাগজের সাহিত্যকীর্তি এলেন গীন্সবার্গীয় বা বিটলস্ ম্যানিয়ায় আক্রান্ত হয়ে একেবারে বিগড়ে গেছে। নব্বই দশকের ছোট আকৃতির কাগজের কথা বললে, বলা যাবে অনেক কাগজের কথাই কিন্তু চরিত্রগত এবং গুরুত্বের দিক থেকে দ্রষ্টব্য, ফৃ স্কুল স্ট্রিট, সূচক, উটপাখি, সাঁতার, মঙ্গলসন্ধ্যা, চালচিত্র, পত্তর, আড্ডারু, মন্ত্র, নন্দন, ছাপাখানা, ডামি এডিশান, আবৃত্তিলোক, উত্তর আধুনিক, লিরিক, সমুজ্জ্বল সুবাতাস, জীবনানন্দ, অণৃন্য, কারুজ, মেঘ, অঞ্জলি লহ মোর, মস্তক, অনুধ্যান, অক্ষর, ধাবমান, ছাট কাগজের মলাট, কফিন টেক্সট, বিকাশ, বালুচর, পথিক, কালোকাগজ, এইতো এখানে এমন, রা, জলদ, বিবিধ, পুষ্পকরথ, ক্যাথারসিস, সুমেশ্বরী, নিরন্তর, শিকড়, ঝড়, মান্দার এইসব ছোটকাগজের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় ইহা অতি ব্যাপক নয়, এছাড়াও উল্লেখ করা যেতে পারে নব্বই দশকের প্রধানতম ছোটকাগজগুলো এখন অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে।
এই দশকেও ছোটকাগজ কেন্দ্রিক উল্লেখযোগ্য কিছুসংখ্যক লেখক বেরিয়ে আসেন। মুজিব মেহদী, রাজীব নূর, ব্রাত্য রাইসু, মাহবুব কবির, কামরুজ্জামান কামু, মোস্তাক আহমাদ দীন, শাহেদ শাফায়েত, শিবলী মোকতাদির, আহমেদ নকীব, শোয়াইব জিবরান, রোকন রহমান, আহমদ মিনহাজ, রবিউল করিম, জহির হাসান, আশিক আকবর, মাহবুব মোর্শেদ, জেসমিন মুননী, জাকির তালুকদার, শুভাশিস সিনহা, সুহৃদ শহীদুল্লা, আহমাদ মোস্তফা কামাল, অদিত্ব শাপলা, রহমান হেনরী, নজরুল কবীর, ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ, হেনরী স্বপন, পাপড়ি রহমান, ফারক ওয়াসিফ, সাখাওয়াত টিপু, সাইম রানা, সরোজ মোস্তফা, রওশন ঝুনু, মাসুদার রহমান, গাজী মোবারক, রায়হান রাইন, নভেরা হোসেন, মিজান মল্লিক, প্রিসিলা রাজ, মাতিয়ার রাফায়েল, মাসুদ সেজান, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, অদিতি ফাল্গুনী, মজনু শাহ, বায়েজীদ মাহবুব, জাফর আহমদ রাশেদ, আশরাফ রোকন, আলফ্রেড খোকন, অরূপ রাহী, শতাব্দী কাদের, শামীমুল হক শামীম, টোকন ঠাকুর, মাসুদুল হক, আমীর খসরু স্বপন, আয়শা ঝর্না, সরকার আমিন, শাহেদ কায়েস, মির্জা তাহের জামিল, রাজা সহিদুল আসলাম, শরীফ শাহরিয়ার, মশিউর রহমান খান, শরীফা বুলবুল, শাহনাজ মুন্নী, সাইমন জাকারিয়া, শামীম রেজা, আকরাম খান, তুষার গায়েন, ইভানা ইলিয়াস, তানভীর আহমেদ সিডনী, ফাহমিদুল হক, সরসিজ আলীম, পলল পরাগ, মাসুদ আশরাফ, ওবায়েদ আকাশ, পলাশ দত্ত, জাহানারা পারভীন, চন্দন সাহা রায়, রাজীব আর্জুনি, বদরে মুনীর, তারেক মাহমুদ, বায়তুল্লাহ কাদেরী, মারুফুল আলম, রাদ আহমেদ, বিল্লাল মেহদী, কাজল কানন, অনিন্দ্য জসীম, খলিল মজিদ, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, ইমরুল হাসান এঁরাই মূলত নব্বই দশকের প্রথম সারির মসিয়ে।
দশক বিবেচনা যেকোন কাজে মঙ্গলের পাশাপাশি কিছু অমঙ্গলকর দিকও পরিলতি হয়। বর্তমান রচনাতেও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। আশির দশকে ছোটকাগজ প্রকাশনা জোরালোভাবে শরু হলেও কিছু কিছু কাগজ পূর্ণতা পায় নব্বই দশকে এসে এবং নব্বইয়ের চিহ্নিত প্রায় অধিকাংশ লেখকদের অংশগ্রহণসহ প্রকাশিত হয় আবার নব্বই দশকেও এমন কিছু ছোটকাগজ প্রকাশনা হয় যার সূত্রাসূত্র এবং কর্মীও মূলত আশির দশকের কিংবা তার কাছাকাছি সময়ের এবং তাতে নব্বইয়ের লেখকদের অংশগ্রহণের পাশাপাশি আশির দশকের লেখকদের অংশগ্রহণও পরিলক্ষিত হয় ফলে আলাদা করে দুটি দশককে না দেখাই বরং ভালো। তাছাড়া প্রসঙ্গটি যেহেতু ছোটকাগজ কাজেই কোন দশকে কত প্রগাঢ়ভাবে কাগজ প্রকাশিত হলো এ বিষয়টি লেখকদের সাথে সম্পৃক্ত নয়।
বহুদিন যাবত আমাদের ছোটকাগজের সাহিত্যমান একই বৃত্তের মনে হচ্ছে কিংবা একটি কাগজের প্রকাশনার সাথে অন্য আরেকটি কাগজের চিন্তা-চেতনা বা ভাবগত দিকে প্রায় কাছাকাছি সম্পর্ক দেখা যায়। তাছাড়া এই সময়ের ছোটকাগজে বিশেষ কোনো নিরীক্ষণ নেই। যেহেতু আমাদের দেশে ছোটকাগজ প্রকাশনার রীতি আছে আছে সেই ধারাবাহিকতা রা করেই কিছুসংখ্যক কাগজ প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে কোনোকিছুই নয় সে অর্থে ছোটকাগজও যে একটি প্রতিষ্ঠান সেটিও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং যেসব বিষয় ভাবা যেত, নানা দেশের সাহিত্যমাত্রিক সমন্বয়সহ আমাদের দেশেই রাস্ট্রিয় পলিসি লেভেলে ছোটকাগজের সাহিত্য প্রবণতার যথার্থ গুরুত্ব তৈরি করা। কাজেই সাম্প্রতিক ছোটকাগজ প্রকাশনা বিষয়ে আমি মনে করি, ছোটকাগজের এইসব দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি এবং, ছোটকাগজের সম্পৃক্ততা রয়েছে এরকম অন্যান্য বিষয়গুলোও নতুন করে ভাবা দরকার। এর মধ্যেই শুরু হলো একটি নতুন শতাব্দীর পথচলা। আমাদের সামনে এখন একটি নতুন দশক, নতুন শতক যার শুরুর কাল এখনই। ছোটকাগজ প্রকাশনা যেহেতু সারাবিশ্বেই প্রচলিত এবং ছোটকাগজ ঘিরে অসংখ্য তরুণের আবির্ভাব ঘটে কাজেই সমাগত আগামীর সময়ে ছোটকাগজ থেকে নতুন কিছু পাওয়া আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। অনেক তথ্য প্রযুক্তি আমাদের সামনে উন্মোচিত হবার অপেক্ষায়। আমাদের বিগত শতাব্দীর সমস্ত সাহিত্যের ধ্যান-ধারণা পাল্টে দিয়ে নতুন কর্মী, নতুন ছোটকাগজ, নতুন সাহিত্য দৃষ্টিগত হওয়াও কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা হবে না। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ওয়েব সার্চ ইঞ্জিন গোগুল ব্যবহারসহ আমরা খুব কাছাকাছি এসেছি ফেসবুক, গুড রিডস্-এর অনেক প্রোফাইল বা গ্রুপস্ ইমেইল ব্যবহারকারীদের। বাংলাভাষায়ও সংযোজিত হয়েছে আভাস, সাম হোআর ইন ব্লগ, সচলায়তন, কবিসভা, মতামত, মুক্তমনা, দরিদ্র ডটকম, বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম-এর আর্টস্সহ... জাতিয় দৈনিকের বেশ কয়েকটি ওয়েব সংস্করণ। প্রিন্ট ম্যাটারের সম্পৃক্ততা নেই এরকম সাহিত্যও এখন প্রায় ব্যাক্তি উদ্যোগে অহরহ প্রকাশিত হচ্ছে। ছোটকাগজ বা ছোট ওয়েব যাই হোক কথা হচ্ছে, এখনকার ছোট উদ্যোগের সাহিত্যমাত্রিক বিবেচনাও হওয়া উচিত আরো বেশি মেটাল-ডাইনামিক। যেমন আমরা ভাবতে পারি এই মেগাসিটি ঢাকার আকাশেও আরেকটি স্যাটেলাইট মেগাসিটি ঢাকা’র পরিবেশ, প্রতিবেশ। ভাবতে পারি, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছড়া, চিত্রকলা, নৃত্যকলা, নাট্যকর্ম, সংগীত, আলোকচিত্র ছোটকাগজ বা ছোট উদ্যোগের উপস্থাপন কর্ম আর যত যাই হোক না কেন নতুন সময়কে সামনে রেখেই বর্তমান ছোট উদ্যোগের সাহিত্য হওয়া উচিত। যাকে লক্ষ রেখে, এই শতকের শুরুর কাগজ তথা ওয়েব সাহিত্যের চলা শুরু হতে পারে। আশি এবং নব্বইয়ের ধারাবাহিকতা রা করেই শূন্যের প্রণোদনা প্রায় সমাপ্তির পথে। হতে পারতো বিশেষ বিশেষ সন্দর্শন, পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠতে পারতো কিছুসংখ্যক কবি-লেখকের নিজস্ব সাহিত্য ভাষা কিংবা টোটাল সময়ের সাহিত্যভাষাও। কিন্তু সার্বিকবিচারে এই দশক থেকেও আমরা বিশেষ কিছু পেয়েছি কিনা সে বিষয়ে আমার পর্যাপ্ত সন্দেহ আছে। শুধুমাত্র সন্দেহ নয় আমি বলবো, শূন্যের কবি-লেখকরা পুরো দশকটাই গোল্লায় শ্রম দিয়েছেন। একটি দশকের সাহিত্যকীর্তি যেরকম অর্জিত হতে পারে সে অর্থে এই দশকের সাহিত্যিক ধারণা তো বটেই, ছোটকাগজের ধারণাটিও এখানে প্রায় অর্বাচীন। এটা বিষ্ময়কর যে, ছোটকাগজই বলি বা ছোট আকৃতির কাগজই বলি এই দশকে ব্যাপক হারে কাগজ প্রকাশিত হয়েছে। কয়েকটি কাগজের নাম উল্লেখ করছি খতিয়ে দেখতে পারেন, শূন্যের কবি-লেখক ছোটকাগজ কর্মীদের সংযোজন, এগুলোর সাফল্য কিংবা সম্ভাবনাই বা কতদূর... ব্যাস, লোক, হাওড়, উল্লেখ, একুশের সংকলন, পথরেখা, ব্রাত্য, শালুক, কাশপাতা, দ্রাঘিমা, সমগীত, অমিত্রাক্ষর, শিরদাঁড়া, সুনৃত, কোমল গান্ধার, পর্ব, আরণ্যক, অর্কিড, শব্দপাঠ, দূর্বা, সূর্যঘড়ি, দুয়েন্দে, অথবা সুর্মারঙ, কহন, কাকতাড়ুয়া, পুণ্ড্র, করুল, বোধ, ক্রান্তিক, থিয়েটারওয়ালা, উলুখাগড়া, লেখাবিল, মুক্তক, গুহাচিত্র, ময়মনসিংহ জং, নান্দীপাঠ, কবিতামঞ্চ, কথা, কবিতা সংক্রান্তি, কালনেত্র, সাচি, ঘুড়ি, নাটাই, ছান্দস, সুবিল, কালসুদ্ধি, অরণি, সময়কাল, বনপাংশুল, ০ মাতাল, হরমা, সাম্প্রতিক, মুনাজেরা, নন্দিতা, জ্যোতি, মাওরুম, মৃদুশব্দ, কুঁড়েঘর, ডুমুর, কবিতাপত্র, কাঁদাখোঁচা, চরাচর, সহজ, হালখাতা, থার্ডম্যাগ, দ্বিতীয়বার, বাংলা জার্নাল, দাহপত্র, দোঁয়াশ, নাটোর, বৃত্তালোক, মরাল, ধূলিচিত্র, বাবুই, জলটুঙি, ছায়া, চারবাক, পড়শি, শিল্প সাহিত্য, আলোকপত্র, পোয়েট-ট্রি, বৈঠা, ব্রতকথা, ছায়াবৃত্ত, লাল ইশতেহার, কালিদহ, জাঙ্গাল, যাত্রী, বেহুলা বাংলা, পানসি, ভূ’লুয়া, জিজ্ঞাসু, শ্রুতি, সংশপ্তক, ধানসিঁড়ি, কালস্রোত, প্রতিবুদ্ধিজীবী, শূন্য, নাইল্যাকাডা, অরিত্র, উতঙ্ক, ময়ূখ, কর্ষণ, নাম, অত্রি, অদ্বৈত, তৃণযোগ, অতঃপর, নতুন দিগন্ত, পুনশ্চ, বৃত্তালোক, বিভাস, হাঁটুজল, রোদ্দুর, ইস্টিশন, নীলঘুড়ি, নতুন কণ্ঠস্বর, নীহারিকা, ধলাই, অর্ক, দ্বৈত, সহজিয়া, গন্দম, অরিন্দম, একুশ শতকের স্রোত, অনুঘটক, শালিক জংশন, লাস্টবেঞ্চ ১১৫, বিজ্ঞান চেতনা, বাউলা, সুতরাং, সেন্ট্রাল জেল, বুক রিভিউ, ইক্ষণ, উৎপথ, পথিকৃৎ, গণমুক্তি, ছড়াপত্র, রেলগাছ, জারুল, মেইন রোড, নহলী, অপর, পরশ, দূত, টোঙ, ধমনি, চন্দ্রাবতী, প্রেক্ষণ, শব্দসাঁকো, সম্প্রীতি, প্রাঙ্গণ, ক্রিটিক, বাতিঘর, অর্জন, শতদ্রু, আর্টবিট, ঢোলসমুদ্দুর, গৌড়জন, হার্ডব্রেক, জেব্রা, বউ, অক্টোপাস, রাফ, দাঁড়কাক, আদিবাস।

http://haor-2.blogspot.com/2009/06/blog-post_03.html

শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ২০১০

লিটল ম্যাগাজিন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অপর নাম / রিজোয়ান মাহমুদ

_________
ইংরেজিতে লিটল -এর অর্থ ক্ষুদ্রক্ষুদ্রতার পরিমাপক যন্ত্রে যা কিছু বড়-র চেয়ে ছোট তাই ক্ষুদ্রআকার ও দেহগত সৌষ্ঠব্য ছোট হলেও ক্ষমতায় কতটুকু আজ তা বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেনা হলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এর সঙ্গে যুক্ত কর্মীবৃন্দ, লেখক ও কবি, এ বিষয়ে এত সোচ্চার হবেন কেন? আমাদের এ অঞ্চলে ও ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাঙলা ভাষাভাষি অঞ্চলে লিটল ম্যাগ প্রকাশনার এক অদম্য তাড়না লক্ষ্য করিঅন্যান্য ভাষায়ও পৃথিবীর বহুদেশে এখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হলেও বড় কাগজের আগ্রাসী চরিত্রের কারণে তা অধিকাংশ লুপ্ত হতে চলেছে, তবে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায় নি এখনোসম্ভবত চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণেঠিক ঐ জায়গা থেকে রচিত হয়েছে বাঙলা অঞ্চলের সম্প্রসারিত চিন্তার শক্তিআমরা সামন্তবাদী গ্রামীণ অবকাঠামোগত প্রশাসনিক অব্যবস্থাকে ফেলে নতুন পুঁজিবাদের দিকে অগ্রসর হয়েছি, পুঁজির অসম বিকাশ, ধনী-দরিদ্রের শ্রেণীকরণ অসম সামাজিক বিধান ও রাষ্ট্রিক চিনত্মার দারিদ্রতাকে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে শুধুমাত্র ভোক্তার অধিকার রক্ষা করে একটি শ্রেণীর, তারাই কেবল ঔপনিবেশিক শক্তির ধারকএখানে সাধারণজীবী মানুষের অংশগ্রহণ থাকে নাসাধারণ জনগণের অধিকারের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রকে করে তোলে প্যারাসাইট ও অপর নির্ভরশীলআজ এ কথা প্রণিধানযোগ্য যে পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ জনগণ আধুনিক রাষ্ট্রনির্ভর কথিত গণতন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ঠপুঁজির সঠিক ও যথার্থ ব্যবহার না হলে শুধুমাত্র সুবিধাভোগী শ্রেণীর আর্থ ও আত্মউন্নয়ন ঘটবে, সাধারণ ও নিম্নবর্গীয় জনগণের কোন সুবিধা হবে নাবিশ্বের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল হচ্ছে, পুঁজির অসম ব্যবহারের কারণে পৃথিবীতে শোষক ও শোষিত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীযাদের প্রশ্রয়ে আর বিগলিত চিন্তায় ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে পুঁজির অসম দাপটএসবের ফাঁক ফোঁকরে মৌলবাদ রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার কারণে সুযোগ বুঝে জেঁকে বসেছে সারা দুনিয়ায় ধর্মীয় অন্ধকুসংস্কারে তলিয়ে যাচ্ছে দেশ, মানব সম্প্রদায়এটিকে সামাল দেয়ার জন্যে রক্ষাকবচ হিসেবে কেউ এগিয়ে আসছে নাযে জনগণ শাণিত চিন্তার আধার হয়ে আসবার কথা, তা কর্পোরেট পুঁজির দৌরাত্ম্যে বার বার মুখ থুবড়ে পড়ছেএকটা কথা খেয়াল রাখা খুবই জরুরিঅস উপায়ে অর্জিত পুঁজিকে রক্ষা করার জন্যে আজকাল বড় বড় প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি দৈত্যদানবের মতো ভিজুয়্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটেছে যারা জন্ম দিচ্ছে বিকারগ্রস্ত চিন্তা, নারীকে ভোগ্যপণ্য বানিয়ে নারী স্বাধীনতাকে খর্ব করছেএ থেকে সুন্দরভাবে পরিত্রাণের আর কোন উপায় নেইযেহেতু পুঁজিশাসিত সমাজ ও রাষ্ট্রের কারক হচ্ছে সেসব অনুঘটকরা যারা পুঁজসম রক্ত প্রদাহের ধারক

প্রথমে খানিকটা উল্লেখ করেছি ঔপনিবেশ প্রসঙ্গে; ঔপনিবেশ মুক্ত হয়ে কোন অর্থময়তায় বার বার ঔপনিবেশিক আচরণ ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবচেতনায় যুক্ত হচ্ছিকিংবা কেন স্বকীয়তা ও বিশ্বাসগুলোকে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছিএ সবের একটিই কারণ তা হলো পাশ্চাত্যপ্রিয়তা আধুনিকতার নামে শোষণের শিক্ষাকে সম্প্রসারিত করে আমাদের স্বকৃত দার্শনিক ভূমিকে দুর্বল করাবৃহত্তর ভারতবর্ষের বাঙলা ভাষাভাষি অঞ্চলে ও বাংলাদেশে একটি সুন্দর সমন্বয়বাদী দার্শনিক মনোভূমি আছে, যা চিরায়ত কালের সুন্দর জীবন ব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে পারেযাতে প্রাণ আছে অমিয় ফল্গুধারার মতো, লক্ষ্য স্থির অভাবনীয় সমন্বয়ে বহু ধর্ম মত ও পথের সুমহান অহংকারঅথচ আজ আমরা বিভক্ত জাতীয় ঐক্যমতে, চিন্তায়, একাগ্রতায়এসব বিষয়ে রাজনৈতিকরা ভাবেন একভাবে, আর সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে বেরিয়ে আসা একটি অংশ যারা রুচিবান, ত্যাগী প্রথাবিরোধী ও প্রতিভাবান তারা ভাবেন অন্যভাবে রাজনৈতিকরা যে দৃষ্টিকোণকে সম্মুখে নিয়ে এসবের জনমত আদায় করেন প্রতিভাময় তরুণ তেজীরা দার্শনিক প্রত্যয় থেকে ভেবে এ সমাজকে আলোকিত করার চেষ্টা করেনসে কারণে প্রকাশিত হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লিটল ম্যাগ ও প্রচলিত অর্থবহ চিন্তাগুচ্ছ বড় কাগজের বাইরে ক্ষুদে পত্রিকার শক্ত ভিত প্রচলিত চিন্তার নায়ক আজকের জনপ্রিয় লেখকের মধ্যে থেকে এ কথাটি প্রায়শই বলা হয়ে থাকে যে, বড় কাগজে ঠাঁই করতে না পেরে ছোট কাগজের সৃষ্টিআজ এ কথা বলবার সময় এসেছে যে, শুধুমাত্র লেখা প্রকাশের লোভে বা চিন্তায় ছোট কাগজ বেরোয় না, ছোট কাগজের উদ্দেশ্য মহ, জনগণের মানস চক্ষুকে প্রসারিত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত সেসব নিম্ন বর্গের মানুষ তাদের আদর্শ ও অধিকার সচেতনতাকে প্রকাশ করাই ছোট কাগজের আদর্শ এবং উদ্দেশ্যআজ ছোট কাগজের ভেতর দিয়ে তৈরি হচ্ছে একটি স্বপ্ন ও প্রলম্বিত একটি ইতিহাসমফস্বলীয় অনেক ছোট কাগজের ভেতর দিয়ে রচিত হচ্ছে নতুন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোকায়ত ভিত্তিক চিরজীবী মানুষের স্বপ্নযানস্বউদ্যোগে পত্রিকা বেরুতে পারে ভারতবর্ষে এ ধারণার জন্ম দেয় বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত বঙ্গদর্শনযদিও বঙ্গদর্শনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ছিল আকারে বড়বঙ্গদর্শনের ধারাবাহিকতায় ১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রআত্মপ্রকাশ ঘটেসবুজপত্র সে সময়কালের একটি বিপ্লবও বটেসবুজপত্রকে ঘিরে তসময়ে নতুন ধারার লেখকগোষ্ঠী তৈরি ও চিন্তনের কাজ শুরু হয়সবুজপত্রকেন্দ্রিক ভাষা, সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে প্রমথ চৌধুরীকে সে সময়ে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে ৫০-এর দশক থেকে লিটল ম্যাগাজিন চর্চার আন্দোলন শুরু হয়এর পূর্বে ৩০-এর বুদ্ধদেব বসুর কবিতাপত্র সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় সাহিত্যে ও সাহিত্যিক নির্মাণে সফল ভূমিকা রেখেছিলেনভাষা আন্দোলন ও তপরবর্তী বাংলা ভাষার সাহিত্য চর্চার একটি নিরঙ্কুশ স্বাধীন ভূমি প্রতিষ্ঠার জন্যে বেশ কয়েকটি ছোট কাগজের আত্মপ্রকাশ ঘটে, এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে কয়টি পত্রিকা চিন্তায় ও শ্রমে স্বাধীন সয়ম্ভূকল্পনায় প্রভাবিত হয় সে নতুন কবিতা কবিকণ্ঠ, অগত্যা, সমকাল, পূর্বমেঘ, তাদের মধ্যে অন্যতমপশ্চিমবঙ্গে সুনীল ও শক্তির নেতৃত্বে কৃত্তিবাসএসব ছোট কাগজের চরিত্র ছিল গুণে ও মানে সমাজ সংস্কারক প্রগতিশীল লেখকদের একটি সুনির্দিষ্ট আড্ডাস্থল তৈরি করাকবি ও সাহিত্যিক তৈরির পাশাপাশি সুস্থ সমাজ সংস্কৃতির ধারক বাহক রূপে সুস্থ জাতি চেতনার পরিচায়কের পথও গ্রহণ করে এসব পত্রিকা এই দর্শন ও ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে ঔপনিবেশের ভেতরে বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠীর চিন্তার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে জাতির স্বপ্ন পুননির্মাণের কাজে ব্যাপৃত থাকে ছোট কাগজগুলোস্বাধীনতা উত্তর আমাদের দেশে জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে বড় এবং প্রতিষ্ঠিত কাগজগুলোর পাশাপাশি অসংখ্য ছোট কাগজ প্রকাশিত হতে থাকে এসব কাগজগুলোতে একযোগে নামী ও প্রতিষ্ঠিত লেখকের পাশাপাশি তরুণ ও অনতিতরুণরা লেখালেখি করছেভবিষ্যতেও করবেযদিও আজকাল বড় কাগজগুলোতে সাহিত্যপাতার নামে অসংখ্য জঞ্জাল ছাপানো হচ্ছেতরুণেরা প্রাণিত উচ্ছ্বাসে প্রতিদিন কাগজের পৃষ্ঠা ভরাট করছেএসবের ভেতরে প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে ব্যক্তি পরিচয়, তোষামোদ, এমনকি নিত্য ব্যবহার্য উপহার প্রদানের অফুরন্ত চেষ্টাএসব অনিয়ম ও অপচেষ্টার ভেতরে স্বাধীনতা উত্তর আমাদের অস্থির সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডই দায়ীপ্রথমতঃ স্বাধীনতা উত্তর আমাদের ভেতরে জেগে ওঠে এক ধরনের উন্মাতাল সাংস্কৃতিক চেতনা যা বাঙালির ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক উত্তারাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল নাদ্বিতীয়তঃ স্বাধীনতা প্রাপ্তির কয়েক বছরের মধ্যে পুঁজিবাদী সমাজের ভেতরে নিজেদের দোষকর্ম সামাজিক অপরাধ এবং পুঁজি চুরির ঘটনাকে আড়ালে রেখে নিজেদের সাধুসন্ত পুরুষ ও সমাজবাদী সাজাবার জন্যে পুঁজিপতিরা রাতারাতি পত্রিকা প্রকাশ করে প্রেস মালিকানার একচ্ছত্র অধিপতি হয়েছেনবিশেষ করে কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত এসব নামধেয় জাতীয় পত্রিকা সৃজনশীলতার নামে (দুই একটা পত্রিকা বাদে) সৃজনসংকটের ব্যবস্থা করা যাচ্ছেতৃতীয়তঃ তরুণেরা উন্মাতাল ঘোরের মধ্যে থেকে পুঁজির স্রোতে গা ভাসিয়ে এবং নিজেদের তরুণ বুদ্ধিজীবী, কবি ও সাহিত্যিক সাজানোর অপচেষ্টায় নিয়োজিত থেকেছেনএটি কোনভাবে সফল ইতিবাচক সংস্কৃতিকে উন্মোচিত করে না

সংস্কৃতির দেউলিয়াত্বেও শিকার আজকের তরুণ সমাজবড় পত্রিকার ভিড়ে তরুণেরা হারিয়ে ফেলেছেন তরুণতম দর্শন, একাগ্রচিত্ততা, নিষ্ঠা, শ্রম ও স্বকীয়ভূষণপ্রকৃত ছোট কাগজের কর্মীরা ওসবের ধারে কাছে নেই, তাদের কমিটমেন্টে থাকে সমাজ দর্শন, রাষ্ট্র দর্শন এবং ভেতরে থাকে নিজস্ব কাব্যদর্শনজাতীয় বড় কাগজগুলো যখন বসত্মাপচা চিন্তাহীন সাহিত্যকর্ম নিয়ে দশকওয়ারী জনপ্রিয়খেতাবে ভূষিত কবি ও সাহিত্যিক তৈরির দায়িত্ব নিয়ে ফেলেন, তখন থেকে একজন লিটল ম্যাগ কর্মীর ভেতরে নিজেকে আলাদা করে প্রস্তুত ও প্রকাশ করার অদম্য ইচ্ছা কাজ করতে থাকেস্ট্যাবলিশমেন্ট সাহিত্যের প্রৌঢ় চিন্তা যা সমাজ বিনির্মাণে সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের মধ্যে কোন কাজ করতে পারে না, সে সমস্ত কল্পনাহীন অথর্ব চিন্তার খোঁয়াড়ে আঘাত করে একটি লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম হয়যেহেতু পুঁজির অসম বিকাশের পথ ধরে এর যাত্রা শুরু হয় না, সেহেতু প্রতিটি লিটল ম্যাগ কর্মীর কমিটমেন্টে থাকে বিপরীত প্রক্রিয়ার সমাজ অন্তর্গত উপাদানের সংশ্লিষ্ট হয়ে পুঁজিতান্ত্রিক জরাগ্রস্ততাকে শনাক্ত করে নিম্নবর্গীয় চেতনার আকাশকে আলোকিত করা

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় যে এ সমস্ত ছোট পত্রিকায় সুনির্দিষ্ট কোন বক্তব্য নেইকিছু কবিতা, গল্প, পুস্তুক সমালোচনা সাক্ষাকার ও চিন্তাহীন গদ্যের আড়ত নিয়ে প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারি বিজ্ঞাপন নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে বিবিধ ছোট কাগজএ ধারা থেকে বেরিয়ে এসে মধ্য আশির কাব্য কর্ষকরা যারা কবিতাকে ধরেছে জীবনের অমিত সম্ভাবনার ভেতরে নতুন এক প্রত্যয়েমাটি, মানুষ, গ্রামীণ আলেখ্যের ধ্যানরত প্রকৃতির সহজচারণ বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল এসব কবিতাইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক নতুন অন্তর্বয়নের ভেতরে জাতীয় জাগরণের সত্তায় পরিণত হয়েছেএরই নাম উত্তর আধুনিকতাদুশ বছরের আধুনিক কবিতার রহস্যঘেরা জটিল গ্রন্থি থেকে উত্তর আধুনিক কবিতার স্থানিক অনুভূতিতে প্রাণের সঞ্চার হয়েছেউত্তর আধুনিকতা উত্তর ঔপনিবেশবাদ ক্ষমতার দুর্বার আকাঙক্ষা ও অহমিকাকে ভেঙে বাংলা কবিতায় উচ্চারিত হচ্ছে লোকায়ত বিশ্বাস পুরাণ এবং প্রান্তিক মানুষের কথাতাদের এই নান্দনিক চিন্তাকে বহন করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে কিছু লিটল ম্যাগলিরিকতাদের অন্যতমকারণ পাঠকের রুচি ও সূচির পরিবর্তনে বিগত তিন দশক লিরিক কাজ করে চলেছেএছাড়াও সুদর্শনচক্র, চম্পকনগর, জোড়াসাঁকো, একলব্য, একবিংশ, চারবাক, সমুজ্জ্বল সুবাতাস একই ঘরনার মধ্যে থেকে চিনত্মার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করছে সমস্ত ছোট কাগজ নিছক কোন কবিতা, প্রবন্ধ, আলোচনা দিয়ে শুরু হয় নাভেতরে থাকে প্রকাশনার গুঢ়ার্থ এবং দার্শনিক প্রত্যয়ফলে বিপরীত স্রোতে ধাবিত হয়ে খড়কুটো ভাসানোর ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এ সমস্ত ছোট কাগজদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একঝাঁক তরুণের দীর্ঘশ্বাস ও ঘ্রাণে মুখরিত হয়ে আরো কিছু লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়, মধ্যাহ্ন, পংক্তিমালা, কালধারা, চর্চা, মৃগয়া, ছাড়পত্র, অগ্রবীজ, চরাচর, পুষ্পকরথ, ধলেশ্বরী, অর্চনা, কাদামাটি, ইস্পাত, অন্তরীপ, জীবনানন্দ, পলিমাটি, আকর, চাষী, মঙ্গল সন্ধ্যা, দ্রষ্টব্য, সত্তা, অরুন্ধতী, রক্তবীজ, প্রান্ত, প্রেক্ষণ, প্রসূন, শ্রাবণের আড্ডা, শব্দসাঁকো, প্রবাহ, জলঘড়ি, অর্ক, দ্বিতীয় চিন্তা, দ্রাবিড়, বাতিঘর, ফলক, স্বাতন্ত্র্য, ঢেউ, উত্তর আধুনিক, উচক্র, মূলধারা, কথামৃত, দ্রোনাচার্য, পাঠক্রম, চোখ, আড্ডারু সমন্বয় ইত্যাদিউল্লেখিত পত্রিকার মধ্যে মধ্যাহ্ন, পুষ্পকরথ, চরাচর ও ঢেউ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে সমস্ত পত্রিকাও ধারণ করে তারুণ্যের চিন্তা এবং স্ট্যাবলিশমেন্ট বিরোধী আদর্শ

নিজের লেখা নিজের ইচ্ছে ও স্বাধীনতায় প্রকাশ করবে বলে অনেক সম্পাদক এভাবে মতামত ব্যক্ত করেনপ্রকৃত অর্থে বড় পত্রিকাগুলো রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় থাকে বলে, তরুণদের স্বাধীন মতামতকে অনেকাংশে প্রশ্রয় দেয় না, ফলে লিটল ম্যাগের ভেতর দিয়ে প্রচল প্রবাহকে তুড়ি মেরে সাহিত্যেও বিপরীতক্রম ধারা সৃষ্টি হয়একথা সত্য যে, জাতির মানস গঠনে লিটল ম্যাগাজিন অসাধারণ গতিময় ভূমিকা সৃষ্টি করে চলেছেপ্রতিবাদের অপর নাম লিটল ম্যাগাজিনপ্রতিবাদ অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে নয়া ঔপনিবেশবাদী শোষণ জর্জরিত আমাদের স্বদেশ ও সাহিত্যিক মনোভূমিবাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের আকাশে পশ্চিমী নতুনতন্ত্রের আগ্রাসনপাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের শকুনেরা উড়ছে আকাশে কথায় আছে শকুন যত উপরে উড়ণ্ডক না কেন নজর তার ভাগাড়ের দিকেএই ভাগাড় এখন পুঁজিবাদের বাজার, যা কসমোপলিটন মহানগর থেকে ছোট বড় মাঝারি শহর উপশহর, মার্কেট হয়ে অসংখ্য জনপদে বিস্তৃতবাজারে পণ্য বিক্রি হয় খোলা বাজারের নামে, পণ্যের উপাদক অধিকাংশই সাম্রাজ্যবাদী দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এ সমস্ত পণ্যায়ন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দূরাচার ও এদের বিপরীতে প্রকৃত পরিকল্পনায় সাংগঠনিক কার্যকলাপকে কেন্দ্রীয় সুতোয় বাঁধতে পারলে লিটল ম্যাগাজিন খুঁজে পাবে তার নিজস্ব বাজারলিটল ম্যাগাজিনের হবে উটর্যধশর্টণঢ টরপর্ণ বা এসথেটিক মার্কেটউটযর্ধটফর্ধ্র টরপর্ণ এর সঙ্গে সম্পর্ক ব্যতিরেকে একে চলতে হবেএজন্যে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন পরিচালনের জন্য একটি স্বকীয় ও স্বাধীন সংবিধান প্রয়োজনঅর্থ, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা নিয়ে অন্য সকল সংগঠনের মধ্যে যে বিড়ম্বনা ও সংকট উপস্থিত হয় সেদিকে সতর্ক থেকেই লিটল ম্যাগাজিনের সাংগঠনিক কেন্দ্রীয় জেলা এবং গ্রাম কমিটি গঠনে হাত দিতে হবেএক্ষেত্রে নগর মহানগর শহর বাজার গ্রাম সমাজ গঠনের চরিত্রগত ও অবস্থানগত পার্থক্য মনে রাখা প্রয়োজন

http://www.dainikazadi.org/shahitto_details.php?news_id=53

প্রতিষ্ঠান : ছোটকাগজ ও বড়কাগজ / সবুজ তাপস

তরুণদের সাথে কথাবার্তা বললে শোনা যায়, প্রতিষ্ঠান বলতে তারা মূখ্যভাবে বড়কাগজকে বুঝছেনমানে ব্যাপারটা এমন, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নামে তারা বড়কাগজ এবং বড়কাগজের নামে এর সাহিত্যপাতার বিরোধিতা করছেনবড়কাগজের বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগও উত্থাপন করেনউত্থাপিত অভিযোগুলোর যথার্থতা কতটুকু, যেটাকে ছোটকাগজ(আকৃতির কোন পরিমাপ নেই, তবু একটা আকৃতির বাঁধাইকরা কাগজকে ছোটকাগজ বলা হচ্ছে) বলছেন তার বিরুদ্ধেও কী এসব উত্থাপন করা যায়, সাহিত্যের প্রকৃত কাগজ ছোটকাগজ না বড়কাগজ- আমার অভিযাত্রা মূলত এই নিয়ে

ছোটকাগজ প্রতিষ্ঠানবিরোধী না অন্যকিছু
ছোটকাগজ বলতে প্রতিষ্ঠানবিরোধী বারুদ-অস্ত্রবোঝানো হচ্ছেপ্রতিষ্ঠান বলতে যদি বড়কাগজকে বোঝানো হয়, তবে এই সংজ্ঞা যথার্থ নয়আবার রাষ্ট্র, বিদ্যালয়, কারখানা, ব্যাংক ইত্যাদিও যদি প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ হয়, তবে প্রত্যেকটিকে ছোটকাগজের জন্মসঙ্গী বা সহায়ক শক্তি বলা যাচ্ছেতা এই জন্যে যে, বেশিরভাগ ছোটকাগজের আলো দেখার পেছনে থাকছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আশীর্বাদ

ছোটকাগজ এই অর্থে প্রতিষ্ঠানবিরোধী নয়, অন্যকিছু, মনে হচ্ছেযদি বিরোধী, তবে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করা বা বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য লালায়িত হওয়া এর চরিত্র নয়বিজ্ঞাপন প্রচার করলে একে ছোটকাগজত্বহীন বলা যাচ্ছেএবং এই মানদণ্ডে সরকার আশরাফ সম্পাদিত নিসর্গকে পরখ করলে ফলাফল কী পাব? এর লিটল ম্যাগাজিন সংখ্যাটি (ফেব্রয়ারি ২০০৭) জনতা ব্যাংক ও ডেনিয়েল কর্পোরেশন লিমিটেডÑএর বিজ্ঞাপন বহন করল

ছোটকাগজকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী তখনই বলা যাবে, যখন প্রতিষ্ঠানের অর্থ এই যে, কোন স্থিরীকৃত নীতি-প্রথা-আদর্শ, যাকে মৌল বলে মানতে বাধ্য করা হয়এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ হিসেবে লালন শাহ্, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সাম্প্রদায়িকতা, উত্তর-আধুনিকতা, মৌলবাদ ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যায়

ছোটকাগজ ও বড়কাগজ
বড়কাগজকে অনৈতিকতার প্রশ্রয়দানকারী, ছদ্মপ্রগতিশীল এবং নির্বিবাদী ধীরাবস্থার পপাতী বলা হচ্ছেঅনৈতিক কাজ হিসেবে দেখানো হয়, এটি সামাজিক শোষণের হাতিয়ার, সমাজকে বিভ্রান্ত করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা চায়যে কাগজ এই করে, এই চায়Ñতা নিন্দ্যবড়কাগজ এই করতে পারে, মানি, যেহেতু এটি নিউজসর্বস্ব কিšস্পষ্টভাবে এর বিরোধিতা করাতো সাহিত্যমগ্ন ছোটকাগজের কাজ নয় বিরোধিতা করবে ঐ রাজনৈতিক-প্রতিষ্ঠানলালিত ছোটকাগজই, যা প্রত্যভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনে প্রণোদিতসাহিত্যমগ্ন ছোটকাগজ কেবল বড়কাগজের সাহিত্যপাতার বিরোধী হবে, এই তো কথাএই না হয়ে যদি রাজনীতিসচেতন ছোটকাগজের চরিত্র ধারণ করে, তবে এরও অনৈতিক কাজ সম্পাদনকারী বা প্রশ্রয়দানকারী কাগজ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকেছদ্মপ্রগতিশীলতার ব্যাপারে বলা যাকপ্রগতিশীলতা বলতে যদি বর্তমানের পরিবর্তন ও উকর্ষ সাধনের ইচ্ছা পোষণ করাকে বোঝায়, তবে বড়কাগজগুলোকেও প্রগতিশীল বলা যায়কারণ এগুলোও সাহিত্যমগ্ন ছোটকাগজের মতো অবস্থার পরিবর্তন ও উকর্ষ সাধনের ল্েয প্রগতিশীল লেখকদের ভিউজ বা মুক্তচিন্তা ধারণ করে প্রকাশ পাচ্ছেআমার ব্যাপারটা ধরা যাকআমি মূলত যেটাকে ছোটকাগজ বলা হচ্ছে তাতেই লিখিএই কাগজ যদি প্রগতিশীলতার সমর্থক হয়, আমার লেখাকে প্রগতিশীল ঘরানার বলতে হচ্ছেএই কথিত প্রগতিশীল লেখাকে আবার বড়কাগজেও দিচ্ছি, ছাপছেওএই-যে ব্যাপার, এর দ্বারা বড়কাগজকে প্রগতিশীলতার সমর্থক এবং ধারক বলতে হচ্ছে এবং একে নির্বিবাদী ধীরাবস্থার পপাতী বলার যুক্তি থাকছে নাপ্রগতিশীলতার প্রশ্নে, (সবগুলো নয়) কিছু বড়কাগজের মতো কিছু ছোটকাগজকেও ধরা যাচ্ছেমাঈন উদ্দিন জাহেদ সম্পাদিত পুবাকাশ, চৌধুরী গোলাম মাওলা সম্পাদিত নোঙর, সাজ্জাদ বিপ্লব সম্পাদিত স্বল্পদৈর্ঘ্যতো এ-জাতীয় ছোটকাগজকাগজগুলোতে সাহিত্যের নামে ধর্মচর্চা হচ্ছে, পরোভাবে ধর্মীয় রাজনীতির মূলে জল ঢালার কাজ হচ্ছেবাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদনা পদাতিক এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত নতুন দিগন্তকেও ছদ্মপ্রগতিশীল ছোটকাগজের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারিএই জন্যে যে, বাংলার প্রগতিশীলতা জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের সমাজতান্ত্রিক চিন্তার বাস্তবায়নের উপর নির্ভরশীল নয় কাগজটি পরোভাবে মার্ক্সীয় চিন্তা প্রচার করে যাচ্ছেএই কথার বিরুদ্ধে হয়তো বলা হতে পারে, বড়কাগজতো কতকগুলো ব্যবসায়িক সূত্র বা কৌশল অবলম্বন করেএ-ক্ষেেত্র বক্তব্য, যেগুলোকে সূত্র বা কৌশল বলা হচ্ছে, সেগুলোর প্রয়োগ কোনো কোনো ছোটকাগজও করছেনতুন দিগন্ত, উলুখাগড়া এ েেত্র প্রকৃষ্ট উদাহরণকেবল পার্থক্য এই, বড়কাগজের কৌশল স্পষ্ট এবং এই প্রকাশমান-দৃশ্যমান চরিত্র নিয়েই এর পথচলা, আর ছোটকাগজের কৌশলপ্রয়োগ অদৃশ্য এবং ছদ্মবেশধারীএই কথারও যদি বিরোধিতা করা হয়, তবে প্রগতিশীল কাগজ বলতে কোন্ কাগজকে বোঝানো হচ্ছে, বাছবিচার ছাড়া তরুণদের (বেশিরভাগ তরুণের পঠন-পাঠন কমকবিতা কী, তা না বুঝে ভ্রান্তিমান বাক্যরচনা করছেন) লেখাপ্রকাশকারী কোনো কাগজকে, নাকি প্রবীণ নয়- কেবল নবীনদের লেখাপ্রকাশকারী কোনো কাগজকে, বোধগম্য নয়। (বড়কাগজ যদি তরুণদের লেখা বেশি ছাপাতে উদ্যোগী হয়, তবে কী তা ছোটকাগজ হয়ে যাবে?) কথাটা এই জন্যে তুলেছি, বহুলাংশে তরুণরাই (ফারুক সিদ্দিকীদের সংখ্যা খুবই কম) প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নামে ছোটকাগজ আন্দোলন গড়ে তোলেন

বড়কাগজের বিরুদ্ধে অভিযোগ এটাও, এটি স্বগৃহীত সূত্রগুচ্ছ প্রয়োগ করে মানুষকে চিন্তাগতভাবে ব্যাকেটবদ্ধ করে কিন্তু আমরা, ছোট-বড় দুকাগজই মানুষকে বৃত্তবন্দী করার প্রয়াস চালাচ্ছে, দেখতে পাইযে কাগজ যে আদর্শকে প্রগতি (প্রকৃষ্ট গতিউচ্চতর সমাজের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন) মনে করে, তা চাচ্ছেই পাঠকসমাজ তার আদর্শবহ হোক ব্যাপারটা বস্তুুবাদী কাগজ ও ভাববাদী কাগজের ভূমিকার দিকে তাকালে স্পষ্টভাবে বোঝা যাবেএকটি বস্তুবাদী লেখক তথা বিষয়বাদী পাঠকপ্রত্যাশী হলে অন্যটি এর বিপরীত কিছু চাচ্ছেইব্যাপারটা ঐ-যে রাজনীতিসচেতন কাগজের কথা বললাম, সেগুলোতেও দ্রষ্টব্যতাছাড়া একই আদর্শে বিশ্বাসী দুটো কাগজের দিকে তাকালেও দেখবো, প্রতিটি নিজের অবস্থানকে-নিজের কাজকে বাঁকধর্মী তথা বস্তুনিষ্ঠ বলে পাঠককে আকর্ষণ করছে

একটু আগে বড়কাগজের স্বগৃহীত সূত্রগুচ্ছর কথা উল্লেখ করলাম, ছোটকাগজকর্মীরা একে এর বাণিজ্যিক নীতি বলেও নিন্দা করছেনবড়কাগজের বাণিজ্যিক নীতি থাকবেইকেননা, এটি দৈনিক বা সাপ্তাহিক খবরপরিবেশক-এর মালিকপ রয়েছে-এর সাথে সংশ্লিষ্ট লোকদের সম্পর্ক পেশাগতছোটকাগজের সাথেতো অন্য কারো নয়, সম্পাদকেরও পেশাগত সম্পর্ক নেই যেহেতু বড়কাগজের মূখ্য কাজ সংবাদ সরবারাহ করা, সেহেতু সপ্তাহান্তে সাহিত্যপাতা বের না করলেও এর চলেতবু বের করছেকিন্তু এর পরও যদি একে স্বগৃহীত সূত্রগুচ্ছ প্রয়োগ করার কারণে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পণ্যায়নে বিশ্বাসী বলা হয়, কেমন শোনায়আমার মনে হচ্ছে-এর নয়, ছোটকাগজের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ আনা যায়কেননা, ছোটকাগজ-বড়কাগজ দুটোতে মূল্যাংক লেখা থাকলেও বড়কাগজের সাহিত্যপাতায় তা নেই (অর্থা দৈনিক সমকাল ও এজাজ ইউসুফী সম্পাদিত ছোটকাগজ লিরিক-এর গায়ে মূল্যাংক লেখা থাকলেও কালের খেয়ার গায়ে নেইযে-দিন কালের খেয়া বের হচ্ছে সেদিনও দৈনিক সমকালের দাম পূর্বদিনের মতো)আবার দুটোকেই উপযুক্ত ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে পণ্যের মতো বিক্রির জন্য ঝুলিয়ে-সাজিয়ে রাখতে দেখছিছোটকাগজের কোথাও মূল্যাংক উল্লেখ না থাকলে বড়কাগজের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের কিছুটা হলেও মাহাত্ম্য থাকতোএখন ছোটকাগজ যদি দাবি করে, সাহিত্যপ্রচারের এজেন্ডা নিয়ে নেমেছে এবং এটি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পণ্যায়নবিরোধী, তবে তার গায়ে মূল্যাংক লেখা থাকছে কেন, প্রশ্নটা যে-কারোর মনে জাগবেইতো (শিল্প-সাহিত্যের বেলায়) কোন্ কাগজ পণ্যায়নবাদী, ছোটকাগজ না বড়কাগজ, বোঝাই যাচ্ছেবড়কাগজের বাণিজ্যপ্রশ্নে ছোটকাগজকর্মীদের আরেকটি অভিযোগেরও যথার্থতা খুঁজে পাই নাতাদের অভিযোগ, বড়-বড় কবিদের কবিতা ছেপে এটি ব্যবসা করছেঅভিযোগকারীদের জানা দরকার, এদেশে সাহিত্যপাতা পড়ার জন্য যসামান্য পাঠকই বড়কাগজ কেনেনবেশিরভাগ পাঠকদেখছিদলের সদস্য-সাহিত্যপাতার জন্য কাগজ কেনেন না, সাহিত্যপাতার লেখা পড়েন না, কেবল কার কার লেখা আছে দেখেনএই দেখছিদলের বেশিরভাগ সদস্য কবিতা লেখেন, গল্প লেখেন, ছোটকাগজকর্মী...বড়কবির কবিতা ছেপে বড়কাগজ ব্যবসা করতে পারলে ছোটকাগজ তা করে পারে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কার কাছে আছে, জানি নাছোটকাগজকর্মীদের বড়কাগজের বিরুদ্ধে এই-যে আচরণ, একে পকেটে মোবাইল রেখে মোবাইল কোম্পানিকে পুঁজিবাদী বলে গালি দিয়ে কারও মার্ক্সবাদী সাজার অপচেষ্টা করার সাথেও তুলনা করতে পারছি না

উপরে, হইচইপ্রবণ-চঞ্চল ছোটকাগজকর্মীরা বা লেখকরা (আগেই বলেছি, বেশিরভাগই তরুণ) বড়কাগজের নামে এর সাহিত্যপাতার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উত্থাপন করছেন, সেগুলোর কোনো যৌক্তিকতা আছে-কী-নেই, দেখিয়েছিতাদের এই হইচই, যে হিসেবে লেখা ছাপাতে চাচ্ছে সে অনুপাতে বড়কাগজ জায়গা দিতে পারছে না বা দিচ্ছে না বলে, মনে হয়েছেএর জন্য আমি মনে করি, একে তারুণ্যের পদচারণায় বাধাদানকারী বা মননশীলতা-নতুনত্ব বা নিরীায় নিস্পৃহ বলা যায় নাকিন্তু যতটুকু প্রেসার দিয়ে এটি বলা হচ্ছে, ততটুকু উপযুক্ত নয়অর্থা হইচই-এর স্কেল উদারাহওয়ার কথা, ‘তারানয়একে সারাদেশের তরুণদের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে এবং সীমিত দুচারটি পাতায় যথাসম্ভব নবীন-প্রবীণ সবার লেখাই রাখতে হচ্ছে এ-েেত্র উদাহরণস্বরূপ দৈনিক পূর্বকোণের সাহিত্য ও সংস্কৃতি, দৈনিক আজাদীর সাহিত্য সাপ্তাহিকী, দৈনিক সমকালের কালের খেয়া, দৈনিক জনকণ্ঠের জনকণ্ঠ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদের সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকী ও দৈনিক যুগান্তরের সাহিত্য সামায়িকীর নাম উল্লেখ করতে পারিকালের খেয়া মাঝে মাঝে এবং জনকণ্ঠ সাময়িকী প্রত্যেক মাসের প্রথম শুক্রবারে তরুণলেখকসংখ্যা হচ্ছেকোনো কোনো সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কেবল তরুণদের প্রাধান্য দেখিসদ্যবিলুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজের সুবর্ণ রেখায় তরুণদের লেখা বিশেষ গুরুত্ব পেতো

বড়কাগজ ও ছোটকাগজের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে না, যা হাজির করা হচ্ছে তা গৌণএই গৌণ সম্পর্ককে মূখ্য বলে তরুণদের নিয়ে এখানে-ওখানে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা চিল্লাচিল্লি করছেন কেউ-কেউ, করতে থাকবেন সবসময়প্রকৃত সাহিত্যের স্বার্থে দুটোর মধ্যে দ্বন্দ্ব হোক, আমি চাইএমন দ্বন্দ্ব-যা অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক দিক থেকে নয়, সাহিত্যের জায়গা থেকে-মানসুধা মেটানোর ল্েয কেবল প্রতিযোগিতামূলক

একটু আগে প্রকৃত সাহিত্যের প্রসঙ্গ এনেছি সাহিত্যের প্রকৃত কাজটা কী ছোট-বড় দুকাগজে থাকছে? আমি মনে করি, থাকছে তবে নিখুঁতভাবে নয়দুকাগজেই তরুণদের কবিতা বিভিন্ন দোষে দুষ্ট দেখতে পাই (কবিতার পাঠক বলে কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করছি)অতিপঙ্ক্তি তথা অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গের উপস্থিতি, অযৌক্তিক দৃশ্যকল্প নির্মাণপ্রবণতা, ভ্রান্তিমান শব্দ তথা অনুপযুক্ত শব্দের ব্যবহার, যা কবিতার বিষয় নয়-তা নিয়ে কাব্যাভিযান চালনা ইত্যাদি ব্যাপার লণীয়ব্যাপারগুলো আকারসর্বস্ব ছোটকাগজ তথা নামধারী ছোটকাগজগুলোতে প্রকাশিত কবিতায় অতিমাত্রায় পাচ্ছি চন্দন চৌধুরী সম্পাদিত বেহুলা বাংলা, শাহানা আকতার মহুয়া সম্পাদিত ছান্দস, হাফিজ রশিদ খান সম্পাদিত পুষ্পকরথ, ওবায়েদ আকাশ সম্পাদিত শালুক, সুমন সুপান্থ সম্পাদিত স্রোতচিহ্ন, সৈয়দ আকরাম হোসেন সম্পাদিত উলুখাগড়া, সরকার আশরাফ সম্পাদিত নিসর্গ, মনিরুল মনির সম্পাদিত খড়িমাটি, আসমা বীথি সম্পাদিত ঘুড়ি প্রভৃতি ছোটকাগজের বিভিন্ন সংখ্যায়ও দেখতে পাই, বেশকিছু কবিতা (তুলে ধরছি না, কারণ এটি কবিতাবিষয়ক গদ্য নয়) উত্তীর্ণ নয়-প্রকাশযোগ্য নয়, বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো হয়েছেএজাজ ইউসুফী সম্পাদিত লিরিক, হাফিজ রশিদ খান ও চৌধুরী বাবুল বড়য়া সম্পাদিত সমুজ্জ্বলসুবাতাস, আমার সম্পাদিত ঢেউ, মহীন রীয়াদ সম্পাদিত শঙ্খবাস ইত্যাদিও দুষ্ট, তবে এগুলোর দর্শনগত জায়গা খুবই পরিষ্কারযে-কাগজের উদ্দেশ্য কেবল কিছু লেখা নিয়ে প্রকাশ পাওয়া, তাকে আকৃতিসর্বস্ব ছোটকাগজ ছাড়া আর কী বলা যাবেলিরিক, সমুজ্জ্বলসুবাতাস, ঢেউ, শঙ্খবাস ইত্যাদি কাগজের দায় দার্শনিকলিরিক উত্তরআধুনিকতাবাদী, সমুজ্জ্বলসুবাতাস (চতুর্দশ সংখ্যা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামেরপ্রথম সমন্বয়বাদী লিটল ম্যাগাজিন’, কিন্তু প্রথম সংখ্যা থেকেই অঘোষিতভাবে উদ্দিষ্ট ল্েয ধাবমান) বাংলাদেশের সমতলি ও পার্বত্য চিন্তার ঐক্যের ল্েয কাজ করছে- সমন্বয়বাদী আর ঢেউ (অষ্টম সংখ্যা থেকে দর্শনাশ্রয়ী) ও শঙ্খবাস (প্রথম সংখ্যা থেকেই অঘোষিতভাবে দৃষ্টান্তবাদ-সমর্থক) দৃষ্টান্তবাদী সাহিত্যকাগজ। (ছোট-বড়) কাগজদুটোতে তরুণদের কবিতা নিখুঁত পাচ্ছি না কেন? বিভিন্ন কারণ থাকতে পারেপ্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি গোষ্ঠীবদ্ধতাকেগোষ্ঠীর লেখাকে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে এমন হচ্ছেদ্বিতীয় কারণ- সম্পাদকের অযোগ্যতাগোষ্ঠীবদ্ধতা এবং সম্পাদকের অযোগ্যতা নিয়ে অন্যগদ্যে আলোচনা করবএই দুকারণ প্রকৃত সাহিত্যের কাজে কতটুকু খুঁত যুক্ত করে, ভেবে দেখা যেতে পারে

বড়কাগজ-ছোটকাগজ দুটোই প্রকৃত সাহিত্যের নিখুঁত কাগজ (যে-কাগজ দর্শনবান- ঐতিহ্যপ্রেমী ও সমাজসতর্ক, প্রকৃত প্রগতিশীলতা ও মুক্তচিন্তার সমর্থক, দৈশিক নৈতিকতায় আস্থাবান, মূল্যবোধের প্রতি দায়বদ্ধ, শিল্পিত চেতনা উন্মেষের মাধ্যমে জনজীবনে ইতিবাচক প্রভাববিস্তারকারী, তারুণ্যের মননশীল-যৌক্তিক-পরিণত উচ্ছ্বাসের ধারক-পৃষ্ঠপোষক এবং নতুনত্ব-নিরীার উপাসক) হয়ে উঠতে পারে, বিশ্বাস করি তবে তা ছোটকাগজের পে যত সহজ, বড়কাগজের পে তত সহজ নয়ছোটকাগজের কলেবর নির্দিষ্ট নয় বলে এর কর্মীরা স-সতর্ক-সাহিত্যসচেতন হলেই পাবকিন্তু তারা নিখুঁত কাজ করার চিন্তা করছেন না, মহ কিছু করে ফেলছেন-এমন ভাব নিয়ে চেঁছামেছিতে ব্যস্তযদি নিখুঁত কাগজ করতেন, তরুণদের লেখাপ্রকাশপ্রসঙ্গ নিয়ে বড়কাগজের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেয়ার মাহাত্ম্য থাকতোবিশুদ্ধ জায়গা থেকে বড়কাগজের সাথে ছোটকাগজের দ্বন্দ্ব হোক, আমি চাইএখন যদি ছোটকাগজের বারুদ-অস্ত্র ক্রিয়াহীন-নিস্তেজ হয়, যুদ্ধের ফলাফল কী হতে পারে, একটু ভাবতে পারিতাহলে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নামে বড়কাগজের বিপে (বিরোধিতা না করে নিজস্ব কাজে ব্যস্ত থাকা উত্তম) দাঁড়ানোর মানে কী? এর অর্থ যদি এভাবে নির্দেশ করি, বড়কাগজে লেখার সুবিধা আদায়ের ল্েয কিছু সংগঠিত (অসংগঠিত)-উদ্গ্রীব লেখকের সংগ্রাম, কেমন শোনায়আসলে ব্যাপারটা তা-ইআবু হাসান শাহরিয়ার একসময় দৈনিক প্রথম আলো’-এর বিরুদ্ধে বাকোয়াজি করতেন মিডিয়া, প্রতিমিডিয়া, রণজি দাশ- কত্তোসব বলতেনতার কবিতা প্রকাশ করা শুরু করলে তিনি আর কাগজটির বিরোধিতা করেন নি

[
কলরোল, (সম্পাদক- জিল্লুর রহমান রাসেল), প্রথম সংখ্যা, চট্টগ্রাম]


Tanvir Masud