_________
ইংরেজিতে লিটল -এর অর্থ ক্ষুদ্র। ক্ষুদ্রতার পরিমাপক যন্ত্রে যা কিছু বড়-র চেয়ে ছোট তাই ক্ষুদ্র। আকার ও দেহগত সৌষ্ঠব্য ছোট হলেও ক্ষমতায় কতটুকু আজ তা বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। না হলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এর সঙ্গে যুক্ত কর্মীবৃন্দ, লেখক ও কবি, এ বিষয়ে এত সোচ্চার হবেন কেন? আমাদের এ অঞ্চলে ও ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাঙলা ভাষাভাষি অঞ্চলে লিটল ম্যাগ প্রকাশনার এক অদম্য তাড়না লক্ষ্য করি। অন্যান্য ভাষায়ও পৃথিবীর বহুদেশে এখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হলেও বড় কাগজের আগ্রাসী চরিত্রের কারণে তা অধিকাংশ লুপ্ত হতে চলেছে, তবে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায় নি এখনো। সম্ভবত চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে। ঠিক ঐ জায়গা থেকে রচিত হয়েছে বাঙলা অঞ্চলের সম্প্রসারিত চিন্তার শক্তি। আমরা সামন্তবাদী গ্রামীণ অবকাঠামোগত প্রশাসনিক অব্যবস্থাকে ফেলে নতুন পুঁজিবাদের দিকে অগ্রসর হয়েছি, পুঁজির অসম বিকাশ, ধনী-দরিদ্রের শ্রেণীকরণ অসম সামাজিক বিধান ও রাষ্ট্রিক চিনত্মার দারিদ্রতাকে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে শুধুমাত্র ভোক্তার অধিকার রক্ষা করে একটি শ্রেণীর, তারাই কেবল ঔপনিবেশিক শক্তির ধারক। এখানে সাধারণজীবী মানুষের অংশগ্রহণ থাকে না। সাধারণ জনগণের অধিকারের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রকে করে তোলে প্যারাসাইট ও অপর নির্ভরশীল। আজ এ কথা প্রণিধানযোগ্য যে পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ জনগণ আধুনিক রাষ্ট্রনির্ভর কথিত গণতন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ঠ। পুঁজির সঠিক ও যথার্থ ব্যবহার না হলে শুধুমাত্র সুবিধাভোগী শ্রেণীর আর্থ ও আত্মউন্নয়ন ঘটবে, সাধারণ ও নিম্নবর্গীয় জনগণের কোন সুবিধা হবে না। বিশ্বের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল হচ্ছে, পুঁজির অসম ব্যবহারের কারণে পৃথিবীতে শোষক ও শোষিত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। যাদের প্রশ্রয়ে আর বিগলিত চিন্তায় ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে পুঁজির অসম দাপট। এসবের ফাঁক ফোঁকরে মৌলবাদ রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার কারণে সুযোগ বুঝে জেঁকে বসেছে সারা দুনিয়ায়। ধর্মীয় অন্ধকুসংস্কারে তলিয়ে যাচ্ছে দেশ, মানব সম্প্রদায়। এটিকে সামাল দেয়ার জন্যে রক্ষাকবচ হিসেবে কেউ এগিয়ে আসছে না। যে জনগণ শাণিত চিন্তার আধার হয়ে আসবার কথা, তা কর্পোরেট পুঁজির দৌরাত্ম্যে বার বার মুখ থুবড়ে পড়ছে। একটা কথা খেয়াল রাখা খুবই জরুরি। অসৎ উপায়ে অর্জিত পুঁজিকে রক্ষা করার জন্যে আজকাল বড় বড় প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি দৈত্যদানবের মতো ভিজুয়্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটেছে যারা জন্ম দিচ্ছে বিকারগ্রস্ত চিন্তা, নারীকে ভোগ্যপণ্য বানিয়ে নারী স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। এ থেকে সুন্দরভাবে পরিত্রাণের আর কোন উপায় নেই। যেহেতু পুঁজিশাসিত সমাজ ও রাষ্ট্রের কারক হচ্ছে সেসব অনুঘটকরা যারা পুঁজসম রক্ত প্রদাহের ধারক।
প্রথমে খানিকটা উল্লেখ করেছি ঔপনিবেশ প্রসঙ্গে; ঔপনিবেশ মুক্ত হয়ে কোন অর্থময়তায় বার বার ঔপনিবেশিক আচরণ ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবচেতনায় যুক্ত হচ্ছি। কিংবা কেন স্বকীয়তা ও বিশ্বাসগুলোকে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। এ সবের একটিই কারণ তা হলো পাশ্চাত্যপ্রিয়তা। আধুনিকতার নামে শোষণের শিক্ষাকে সম্প্রসারিত করে আমাদের স্বকৃত দার্শনিক ভূমিকে দুর্বল করা। বৃহত্তর ভারতবর্ষের বাঙলা ভাষাভাষি অঞ্চলে ও বাংলাদেশে একটি সুন্দর সমন্বয়বাদী দার্শনিক মনোভূমি আছে, যা চিরায়ত কালের সুন্দর জীবন ব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে পারে। যাতে প্রাণ আছে অমিয় ফল্গুধারার মতো, লক্ষ্য স্থির অভাবনীয় সমন্বয়ে বহু ধর্ম মত ও পথের সুমহান অহংকার। অথচ আজ আমরা বিভক্ত জাতীয় ঐক্যমতে, চিন্তায়, একাগ্রতায়। এসব বিষয়ে রাজনৈতিকরা ভাবেন একভাবে, আর সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে বেরিয়ে আসা একটি অংশ যারা রুচিবান, ত্যাগী প্রথাবিরোধী ও প্রতিভাবান তারা ভাবেন অন্যভাবে। রাজনৈতিকরা যে দৃষ্টিকোণকে সম্মুখে নিয়ে এসবের জনমত আদায় করেন প্রতিভাময় তরুণ তেজীরা দার্শনিক প্রত্যয় থেকে ভেবে এ সমাজকে আলোকিত করার চেষ্টা করেন। সে কারণে প্রকাশিত হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লিটল ম্যাগ ও প্রচলিত অর্থবহ চিন্তাগুচ্ছ বড় কাগজের বাইরে ক্ষুদে পত্রিকার শক্ত ভিত। প্রচলিত চিন্তার নায়ক আজকের জনপ্রিয় লেখকের মধ্যে থেকে এ কথাটি প্রায়শই বলা হয়ে থাকে যে, বড় কাগজে ঠাঁই করতে না পেরে ছোট কাগজের সৃষ্টি। আজ এ কথা বলবার সময় এসেছে যে, শুধুমাত্র লেখা প্রকাশের লোভে বা চিন্তায় ছোট কাগজ বেরোয় না, ছোট কাগজের উদ্দেশ্য মহৎ, জনগণের মানস চক্ষুকে প্রসারিত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত সেসব নিম্ন বর্গের মানুষ তাদের আদর্শ ও অধিকার সচেতনতাকে প্রকাশ করাই ছোট কাগজের আদর্শ এবং উদ্দেশ্য। আজ ছোট কাগজের ভেতর দিয়ে তৈরি হচ্ছে একটি স্বপ্ন ও প্রলম্বিত একটি ইতিহাস। মফস্বলীয় অনেক ছোট কাগজের ভেতর দিয়ে রচিত হচ্ছে নতুন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোকায়ত ভিত্তিক চিরজীবী মানুষের স্বপ্নযান। স্বউদ্যোগে পত্রিকা বেরুতে পারে ভারতবর্ষে এ ধারণার জন্ম দেয় বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’। যদিও বঙ্গদর্শনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ছিল আকারে বড়। বঙ্গদর্শনের ধারাবাহিকতায় ১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ আত্মপ্রকাশ ঘটে। সবুজপত্র সে সময়কালের একটি বিপ্লবও বটে। সবুজপত্রকে ঘিরে তৎসময়ে নতুন ধারার লেখকগোষ্ঠী তৈরি ও চিন্তনের কাজ শুরু হয়। সবুজপত্রকেন্দ্রিক ভাষা, সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে প্রমথ চৌধুরীকে সে সময়ে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে ৫০-এর দশক থেকে লিটল ম্যাগাজিন চর্চার আন্দোলন শুরু হয়। এর পূর্বে ৩০-এর বুদ্ধদেব বসুর কবিতাপত্র সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় সাহিত্যে ও সাহিত্যিক নির্মাণে সফল ভূমিকা রেখেছিলেন। ভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তী বাংলা ভাষার সাহিত্য চর্চার একটি নিরঙ্কুশ স্বাধীন ভূমি প্রতিষ্ঠার জন্যে বেশ কয়েকটি ছোট কাগজের আত্মপ্রকাশ ঘটে, এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে কয়টি পত্রিকা চিন্তায় ও শ্রমে স্বাধীন সয়ম্ভূকল্পনায় প্রভাবিত হয় সে নতুন কবিতা কবিকণ্ঠ, অগত্যা, সমকাল, পূর্বমেঘ, তাদের মধ্যে অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গে সুনীল ও শক্তির নেতৃত্বে কৃত্তিবাস। এসব ছোট কাগজের চরিত্র ছিল গুণে ও মানে সমাজ সংস্কারক প্রগতিশীল লেখকদের একটি সুনির্দিষ্ট আড্ডাস্থল তৈরি করা। কবি ও সাহিত্যিক তৈরির পাশাপাশি সুস্থ সমাজ সংস্কৃতির ধারক বাহক রূপে সুস্থ জাতি চেতনার পরিচায়কের পথও গ্রহণ করে এসব পত্রিকা। এই দর্শন ও ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে ঔপনিবেশের ভেতরে বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠীর চিন্তার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে জাতির স্বপ্ন পুননির্মাণের কাজে ব্যাপৃত থাকে ছোট কাগজগুলো। স্বাধীনতা উত্তর আমাদের দেশে জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে বড় এবং প্রতিষ্ঠিত কাগজগুলোর পাশাপাশি অসংখ্য ছোট কাগজ প্রকাশিত হতে থাকে। এসব কাগজগুলোতে একযোগে নামী ও প্রতিষ্ঠিত লেখকের পাশাপাশি তরুণ ও অনতিতরুণরা লেখালেখি করছে। ভবিষ্যতেও করবে। যদিও আজকাল বড় কাগজগুলোতে সাহিত্যপাতার নামে অসংখ্য জঞ্জাল ছাপানো হচ্ছে। তরুণেরা প্রাণিত উচ্ছ্বাসে প্রতিদিন কাগজের পৃষ্ঠা ভরাট করছে। এসবের ভেতরে প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে ব্যক্তি পরিচয়, তোষামোদ, এমনকি নিত্য ব্যবহার্য উপহার প্রদানের অফুরন্ত চেষ্টা। এসব অনিয়ম ও অপচেষ্টার ভেতরে স্বাধীনতা উত্তর আমাদের অস্থির সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডই দায়ী। প্রথমতঃ স্বাধীনতা উত্তর আমাদের ভেতরে জেগে ওঠে এক ধরনের উন্মাতাল সাংস্কৃতিক চেতনা যা বাঙালির ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক উত্তারাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। দ্বিতীয়তঃ স্বাধীনতা প্রাপ্তির কয়েক বছরের মধ্যে পুঁজিবাদী সমাজের ভেতরে নিজেদের দোষকর্ম সামাজিক অপরাধ এবং পুঁজি চুরির ঘটনাকে আড়ালে রেখে নিজেদের সাধুসন্ত পুরুষ ও সমাজবাদী সাজাবার জন্যে পুঁজিপতিরা রাতারাতি পত্রিকা প্রকাশ করে প্রেস মালিকানার একচ্ছত্র অধিপতি হয়েছেন। বিশেষ করে কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত এসব নামধেয় জাতীয় পত্রিকা সৃজনশীলতার নামে (দুই একটা পত্রিকা বাদে) সৃজনসংকটের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। তৃতীয়তঃ তরুণেরা উন্মাতাল ঘোরের মধ্যে থেকে পুঁজির স্রোতে গা ভাসিয়ে এবং নিজেদের তরুণ বুদ্ধিজীবী, কবি ও সাহিত্যিক সাজানোর অপচেষ্টায় নিয়োজিত থেকেছেন। এটি কোনভাবে সফল ইতিবাচক সংস্কৃতিকে উন্মোচিত করে না।
সংস্কৃতির দেউলিয়াত্বেও শিকার আজকের তরুণ সমাজ। বড় পত্রিকার ভিড়ে তরুণেরা হারিয়ে ফেলেছেন তরুণতম দর্শন, একাগ্রচিত্ততা, নিষ্ঠা, শ্রম ও স্বকীয়ভূষণ। প্রকৃত ছোট কাগজের কর্মীরা ওসবের ধারে কাছে নেই, তাদের কমিটমেন্টে থাকে সমাজ দর্শন, রাষ্ট্র দর্শন এবং ভেতরে থাকে নিজস্ব কাব্যদর্শন। জাতীয় বড় কাগজগুলো যখন বসত্মাপচা চিন্তাহীন সাহিত্যকর্ম নিয়ে দশকওয়ারী ‘জনপ্রিয়’ খেতাবে ভূষিত কবি ও সাহিত্যিক তৈরির দায়িত্ব নিয়ে ফেলেন, তখন থেকে একজন লিটল ম্যাগ কর্মীর ভেতরে নিজেকে আলাদা করে প্রস্তুত ও প্রকাশ করার অদম্য ইচ্ছা কাজ করতে থাকে। স্ট্যাবলিশমেন্ট সাহিত্যের প্রৌঢ় চিন্তা যা সমাজ বিনির্মাণে সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের মধ্যে কোন কাজ করতে পারে না, সে সমস্ত কল্পনাহীন অথর্ব চিন্তার খোঁয়াড়ে আঘাত করে একটি লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম হয়। যেহেতু পুঁজির অসম বিকাশের পথ ধরে এর যাত্রা শুরু হয় না, সেহেতু প্রতিটি লিটল ম্যাগ কর্মীর কমিটমেন্টে থাকে বিপরীত প্রক্রিয়ার সমাজ অন্তর্গত উপাদানের সংশ্লিষ্ট হয়ে পুঁজিতান্ত্রিক জরাগ্রস্ততাকে শনাক্ত করে নিম্নবর্গীয় চেতনার আকাশকে আলোকিত করা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় যে এ সমস্ত ছোট পত্রিকায় সুনির্দিষ্ট কোন বক্তব্য নেই। কিছু কবিতা, গল্প, পুস্তুক সমালোচনা সাক্ষাৎকার ও চিন্তাহীন গদ্যের আড়ত নিয়ে প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারি বিজ্ঞাপন নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে বিবিধ ছোট কাগজ। এ ধারা থেকে বেরিয়ে এসে মধ্য আশির কাব্য কর্ষকরা যারা কবিতাকে ধরেছে জীবনের অমিত সম্ভাবনার ভেতরে নতুন এক প্রত্যয়ে। মাটি, মানুষ, গ্রামীণ আলেখ্যের ধ্যানরত প্রকৃতির সহজচারণ বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল এসব কবিতা। ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক নতুন অন্তর্বয়নের ভেতরে জাতীয় জাগরণের সত্তায় পরিণত হয়েছে। এরই নাম ‘উত্তর আধুনিকতা’ দু’শ বছরের আধুনিক কবিতার রহস্যঘেরা জটিল গ্রন্থি থেকে উত্তর আধুনিক কবিতার স্থানিক অনুভূতিতে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। উত্তর আধুনিকতা উত্তর ঔপনিবেশবাদ ক্ষমতার দুর্বার আকাঙক্ষা ও অহমিকাকে ভেঙে বাংলা কবিতায় উচ্চারিত হচ্ছে লোকায়ত বিশ্বাস পুরাণ এবং প্রান্তিক মানুষের কথা। তাদের এই নান্দনিক চিন্তাকে বহন করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে কিছু লিটল ম্যাগ। ‘লিরিক’ তাদের অন্যতম। কারণ পাঠকের রুচি ও সূচির পরিবর্তনে বিগত তিন দশক লিরিক কাজ করে চলেছে। এছাড়াও সুদর্শনচক্র, চম্পকনগর, জোড়াসাঁকো, একলব্য, একবিংশ, চারবাক, সমুজ্জ্বল সুবাতাস একই ঘরনার মধ্যে থেকে চিনত্মার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করছে। এ সমস্ত ছোট কাগজ নিছক কোন কবিতা, প্রবন্ধ, আলোচনা দিয়ে শুরু হয় না। ভেতরে থাকে প্রকাশনার গুঢ়ার্থ এবং দার্শনিক প্রত্যয়। ফলে বিপরীত স্রোতে ধাবিত হয়ে খড়কুটো ভাসানোর ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এ সমস্ত ছোট কাগজ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একঝাঁক তরুণের দীর্ঘশ্বাস ও ঘ্রাণে মুখরিত হয়ে আরো কিছু লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়, মধ্যাহ্ন, পংক্তিমালা, কালধারা, চর্চা, মৃগয়া, ছাড়পত্র, অগ্রবীজ, চরাচর, পুষ্পকরথ, ধলেশ্বরী, অর্চনা, কাদামাটি, ইস্পাত, অন্তরীপ, জীবনানন্দ, পলিমাটি, আকর, চাষী, মঙ্গল সন্ধ্যা, দ্রষ্টব্য, সত্তা, অরুন্ধতী, রক্তবীজ, প্রান্ত, প্রেক্ষণ, প্রসূন, শ্রাবণের আড্ডা, শব্দসাঁকো, প্রবাহ, জলঘড়ি, অর্ক, দ্বিতীয় চিন্তা, দ্রাবিড়, বাতিঘর, ফলক, স্বাতন্ত্র্য, ঢেউ, উত্তর আধুনিক, উচক্র, মূলধারা, কথামৃত, দ্রোনাচার্য, পাঠক্রম, চোখ, আড্ডারু সমন্বয় ইত্যাদি। উল্লেখিত পত্রিকার মধ্যে মধ্যাহ্ন, পুষ্পকরথ, চরাচর ও ঢেউ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এ সমস্ত পত্রিকাও ধারণ করে তারুণ্যের চিন্তা এবং স্ট্যাবলিশমেন্ট বিরোধী আদর্শ।
নিজের লেখা নিজের ইচ্ছে ও স্বাধীনতায় প্রকাশ করবে বলে অনেক সম্পাদক এভাবে মতামত ব্যক্ত করেন। প্রকৃত অর্থে বড় পত্রিকাগুলো রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় থাকে বলে, তরুণদের স্বাধীন মতামতকে অনেকাংশে প্রশ্রয় দেয় না, ফলে লিটল ম্যাগের ভেতর দিয়ে প্রচল প্রবাহকে তুড়ি মেরে সাহিত্যেও বিপরীতক্রম ধারা সৃষ্টি হয়। একথা সত্য যে, জাতির মানস গঠনে লিটল ম্যাগাজিন অসাধারণ গতিময় ভূমিকা সৃষ্টি করে চলেছে। প্রতিবাদের অপর নাম লিটল ম্যাগাজিন। প্রতিবাদ অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে নয়া ঔপনিবেশবাদী শোষণ জর্জরিত আমাদের স্বদেশ ও সাহিত্যিক মনোভূমি। বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের আকাশে পশ্চিমী নতুনতন্ত্রের আগ্রাসন। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের শকুনেরা উড়ছে আকাশে। কথায় আছে শকুন যত উপরে উড়ণ্ডক না কেন নজর তার ভাগাড়ের দিকে। এই ভাগাড় এখন পুঁজিবাদের বাজার, যা কসমোপলিটন মহানগর থেকে ছোট বড় মাঝারি শহর উপশহর, মার্কেট হয়ে অসংখ্য জনপদে বিস্তৃত। বাজারে পণ্য বিক্রি হয় খোলা বাজারের নামে, পণ্যের উৎপাদক অধিকাংশই সাম্রাজ্যবাদী দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এ সমস্ত পণ্যায়ন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দূরাচার ও এদের বিপরীতে প্রকৃত পরিকল্পনায় সাংগঠনিক কার্যকলাপকে কেন্দ্রীয় সুতোয় বাঁধতে পারলে লিটল ম্যাগাজিন খুঁজে পাবে তার নিজস্ব বাজার। লিটল ম্যাগাজিনের হবে উটর্যধশর্টণঢ টরপর্ণ বা এসথেটিক মার্কেট। উটযর্ধটফর্ধ্র টরপর্ণ এর সঙ্গে সম্পর্ক ব্যতিরেকে একে চলতে হবে। এজন্যে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন পরিচালনের জন্য একটি স্বকীয় ও স্বাধীন সংবিধান প্রয়োজন। অর্থ, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা নিয়ে অন্য সকল সংগঠনের মধ্যে যে বিড়ম্বনা ও সংকট উপস্থিত হয় সেদিকে সতর্ক থেকেই লিটল ম্যাগাজিনের সাংগঠনিক কেন্দ্রীয় জেলা এবং গ্রাম কমিটি গঠনে হাত দিতে হবে। এক্ষেত্রে নগর মহানগর শহর বাজার গ্রাম সমাজ গঠনের চরিত্রগত ও অবস্থানগত পার্থক্য মনে রাখা প্রয়োজন।
http://www.dainikazadi.org/shahitto_details.php?news_id=53
শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ২০১০
লিটল ম্যাগাজিন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অপর নাম / রিজোয়ান মাহমুদ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন