মঙ্গলবার, ২৪ আগস্ট, ২০১০

ছোটকাগজ: আশি, নব্বই এবং শূন্যের সম্ভাবনা (পরিমার্জিত) / মাহমুদ সীমান্ত


সাকুল্যে ছোটকাগজ
সাহিত্যের একটি ধারণামাত্র। সাহিত্য প্রকাশনায় এটি একটি বিকল্প মাধ্যমব্যতীত বিশেষ কোনকিছু নয়। ভুল কর্ম সম্পাদনে কখনো কখনো তা ছোট আকৃতির কাগজও বটে। ছোট ছোট প্রেক্ষাপট থেকে ছোট ছোট অনুষঙ্গ নিয়েই ছোটকাগজের উদ্ভাবনা। সমস্যা, সম্ভাবনা নিয়েই যা আমাদের দেশেও এ ধারণার সাহিত্য প্রকাশনার প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে ছোটকাগজ প্রকাশনা আজ যতটা প্রসারিত- ধরা যায়, বিগত বছর ত্রিশেক পূর্বে ততটা হিরিক ছিলো না। এই সময়ে কম করে হলেও একশটি ম্যাগাজিন সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয়। বছর ত্রিশেক পূর্বে, তখনকার ছোটকাগজ কর্মীরা এরকম করে ভাবতেই পারেননি- ভাবতেই পারেননি বলতে তখনকার সময় ছোটকাগজ প্রকাশনায় এত সুযোগ কিংবা এত কর্মীও ছিলো না। আজকের ছোটকাগজ প্রকাশনার এই প্লাটফর্মটি মূলত সেই দুর্যোগের সময় থেকেই তৈরি হয়েছে। সমগ্র একটা বিপর্যস্ত দেশ, প্রতিষ্ঠানগুলির বিমুখতা এইসব সমস্যাবলির মুখোমুখি হয়েই তখনকার কর্মীদের ছোটকাগজ বিষয়টি ভাবতে হয়েছিলো। ফলে তাঁদের যে যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় এগুতে হয়েছিলো এই সময়ের একজন কর্মীর সামনে তেমন কোনো সমস্যাই জড়িত নয়। বলা যায়, পূর্ববর্তীদের তৈরি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েই এই সময়ের কর্মীরা স্বাচ্ছন্দে কাজ করে যাচ্ছেন। এটা অবশ্য পূর্ববর্তী সময়ের সাথে তুলনা সাপেক্ষ কিন্তু সার্বিকভাবে ছোটকাগজ কর্মীরা যে, স্বাচ্ছন্দ ভোগ করছেন তা নয়।
ছোটকাগজ কর্মীদের অধিকাংশই থাকেন তরুণ, অখ্যাত, অর্থহীন অথচ প্রবল প্রাণশক্তিসম্পন্ন ফলে বছর বছর ছোটকাগজ প্রকাশনাও বেড়ে চলেছে সারাদেশে। আসছে নতুন কর্মী। যদিও কোন কোন কর্মী বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রাণশক্তিহীন হয়ে এ পথ ছেড়ে দেন। তাঁর উক্ত অভাব পূরণের জন্য কোন না কোন নতুন কর্মী এগিয়ে আসেন। পূর্ববর্তী সময়ের বহু ছোটকাগজ প্রকাশনা আজ বন্ধ হয়ে গেছে, বহুবিদ অসহযোগিতা আর সমস্যার একঘেয়েমিই এর কারণ। ‘সিসটেমিটি দি সারভাইবাল ওয়ার্ক বাই প্রটোকল’ এটিও একটি কারণ আবার কখনো কখনো লেখকদের বিচ্ছিন্নতাই প্রধান কারণ হয়েছে। এরকম অনেক উদ্ভট পরিস্থিতি থেকেই আবার কোনো কোনো কাগজ আত্মপ্রকাশও করতে পারে না, সমাপ্তি ঘটে যায় পরিকল্পনাতেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন গোষ্ঠিবদ্ধতার ধারণাটি পরিস্কার হয়ে ওঠে না ফলে এ জায়গায়ও ছোটকাগজের ভিত্তিভূমিটি পতিত থেকে যায়। অবশ্য আরও একটি বড় সমস্যা হলো সরকারিভাবে ছোটকাগজের উপর সহযোগিতা প্রদানের অভাব। একথা সত্য যে, বাংলাদেশে ছোটকাগজ প্রকাশনা আজ যতটা প্রসারিত তারচেয়েও বহুগুণ প্রসারিত হতে পারতো যদি তাতে সরকারি/বেসরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা থাকতো। আমাদের ছোটকাগজকে ঘিরে যেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারাই ছোটকাগজ প্রকাশনা গতিকে আরও ব্যাপকভাবে করে দিতে পারেন, নিজেদের প্রকাশনার বিজ্ঞাপন দিয়ে। তাতে যেমন ছোটকাগজের অল্পবিস্তর অর্থের সমৃদ্ধি আসতো আর নতুন নতুন উতসাহী কর্মীও পাওয়া যেতো। আবার নিজেদের প্রকাশনাগুলো যেমন ব্যাপক পাঠকের হাতে পৌঁছানো সম্ভব ছিলো, ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিও অর্জিত হতো পাশাপাশি ছোটকাগজ প্রকাশনাগতিও ধরে রাখা সম্ভব ছিলো। কিন্তু আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলির এরকম যথেষ্ট উন্নাসিকতার কারণে বিভিন্ন প্রকাশকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তেমনই ছোটকাগজের ব্যাপক প্রকাশনাগুলি পিছিয়ে যাচ্ছে আরো বেশি।
শুধু এটাই নয় আরো ভাবা যেতে পারে। এখন তো ছোটকাগজগুলির সংঘবদ্ধ হওয়ার মতো ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় ছোটকাগজের বিক্রিও নিশ্চিত হয়েছে। আমি জানি, সেটা আমার হাত দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সার্বিক ছোটকাগজের আর্থ-সামাজিক বা নিকট ভবিষ্যতের অবস্থার কথা চিন্তা করলে দেখা যায় সময়ের প্রেক্ষাপটে তা আসলে কিছুই নয়। ছোটকাগজের সকল প্রকাশনাই যে অত্যন্ত সিরিয়াস কিছু তা অবশ্য নয়। সকল ছোটকাগজ যুক্তিসংগতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে না কোন কোন কাগজ যুক্তিসংগতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে এক কাগজের সৃষ্ট জটিলতা অন্য কাগজের উপর গিয়ে পড়ছে। অন্যদিকে ছোটকাগজের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কতিপয় লেখক-কবি তাদের নতুন লেখনিটি আত্মবিশ্বাসের সাথেই ছোটকাগজে মুদ্রিত করে থাকেন। যখন তার লেখাটি বিশেষ কোন আলোচনা বা সমালোচনায় চলে আসে তার গুণাগুণ যেমন লেখকস্বত্তাটির উপর পড়ে থাকে তেমনই এর কৃতিত্ব চলে আসে ছোটকাগজের উপরেও। তথ্য-প্রযুক্তির এসময়ে নব্য নব্য ধারণার যেমন প্রতিফলন সম্ভব তেমনি সম্ভব সুদূর সাহিত্যের উজ্জ্বল চিত্রটি আমাদের প্রান্তিক পাঠকশ্রেণিকেও জানিয়ে দেয়া। পিছিয়ে পড়া এ অংশটি আরেকটু সক্রিয় ভূমিকায় নিয়ে আসতে ছোটকাগজের কর্মীদের উচিত পরাক্রম সংঘবদ্ধতায় সম্মিলিত হওয়া।
স্বাধিনতা পরবর্তী বাংলাদেশে যেসব ছোটকাগজ প্রকাশিত হয় তার মধ্যে আশির দশকে প্রকাশিত কাগজগুলোই আজও আমাদের কাছে সর্বাগ্রে গৃহীত হচ্ছে তাদের যথার্থ কাজের জন্যে। পুরো নব্বই দশকে আমার চোখে পড়েনি এমন একটি ছোটকাগজের উত্তরণ যা আশির দশকের সেইসব কাগজের সংগে তুলনা করতে পারি। আশির দশকে কিছু উল্লেখযোগ্য কাগজ হলো গাণ্ডীব, প্রসূণ, সংবেদ, কিছুধ্বনি, রূপম, পেঁচা, প্রান্ত, নিসর্গ, লিরিক, অনিন্দ্য, একবিংশ, নদী, প্রতিশিল্প, দ্রষ্টব্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য, সৃজনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমি পত্রিকা, কালধারা, দ্বিতীয় চিন্তা, লোকায়ত ইত্যাদি। এছাড়া আরও দু’একটি কাগজ অনায়াসে বের করা সম্ভব কিন্তু পুরো নব্বই দশকে সে রকম কোন ছোটকাগজ কি বের করা সম্ভব? এই লেখাকে একটি দশকের প্রতিপক্ষ অর্থে বিবেচনা না করে সত্যিকার ছোটকাগজের প্রেক্ষাপটটি বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে।
আশির দশকে ছোটকাগজ ঘিরে কিছু সংখ্যক উল্লেখযোগ্য লেখক বেরিয়ে এসেছেন যাদের মধ্যে এখনও কেউ একেবারেই ছোটকাগজে লিখে চলেছেন আবার কেউ কেউ ছোটকাগজের পাশাপাশি অন্যান্য প্রকাশনায়ও লিখে যাচ্ছেন। সেলিম মোরশেদ, সাজ্জাদ শরিফ, তপন বড়ুয়া, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, পারভেজ হোসেন, শোয়েব শাদাব, কাজল শাহনেওয়াজ, বিষ্ণু বিশ্বাস, আহমেদ মুজিব, ফরিদ কবির, সৈয়দ নাজমুল করিম, কফিল আহমেদ, রিফাত চৌধুরী, শান্তনু চৌধুরী, কামরুল হাসান, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, মঈন চৌধুরী, মাসুদ খান, সরকার মাসুদ, সাদ কামালী, জুয়েল মাজহার, বদরুল হায়দার, কামরুল হুদা পথিক, ফেরদৌস নাহার, আবু হাসান শাহরিয়ার, খালেদ হামিদী, শামীম আজাদ, সঞ্জিব চৌধুরী, সরকার আশরাফ, সুহিতা সুলতানা, শিহাব শাহরিয়ার, সাইমুম রাজু, সৈয়দ তারিক, ইমতিয়ার শামীম, স্বদেশ বন্ধু সরকার, শামসুল কবির, আহমেদুল বারী, নুরুন্নাহার শিরীন, ইয়াসিনুর রহমান, খালেদ হোসাইন এইসব লেখককুলই মূলত আশির দশকের প্রধান লিখিয়ে। এঁরা সকলেই আশির ছোটকাগজের লেখক হিসেবে অগ্রগণ্য। যদিও ছোটকাগজের প্রচল ধারণায় টিকে থাকেননি অনেকেই তবু অধিকাংশের প্রভাববিস্তার এখনো ছোটকাগজে বহাল রয়েছে।
বাংলাদেশে স্বাধিনতাযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালটা কখনোই প্রকৃত সাহিত্যের জন্যে মঙ্গলজনক অধ্যায় বলে বিবেচনা করা যায় না। দেশের এরকম বিপর্যয়ের পর সত্তর দশকের লেখককুলসহ পূর্ববর্তী সময়ের কিছু কিছু লেখক একপেঁষেভাবে বিপর্যয় তথা স্বাধিনতাগীতি, রাজনৈতিক শ্লোগানচারিতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন ফলে কবিতা কিংবা গদ্য সাহিত্যে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ায় আশির দশকের লেখকদের একটু ভিন্নভাবেই ভাবতে হয়েছিলো সাহিত্যের নানা বাঁক বা দিকভাষ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে। উত্তাল, উদ্দাম সময়টা ছিল এরকমই। যখন শিরার টানে রক্ত উত্তপ্ত হয়ে ফেনিল, উপচে পড়তে পারে। পূর্ববর্তী লেখককুলের আশ্রয়হীনতা, সরকারি অসহযোগিতা, গ্লোবালাইজেশন, প্রকৃত সাহিত্য উদঘাটন, সাহিত্যকে নতুন করে ভাবা, নতুন কিছু সৃষ্টি করার উদ্যোমি মানসিকতা, নতুনের গুরুত্ব তৈরি করা এইসব কারণেই মূলত তাঁদের নতুন একটা প্লাটফর্ম- ছোটকাগজ, অত্যন্ত জোরালোভাবে ভাবতে হয়েছিলো সাহিত্যেও। এটাকে একটা বড় ধরনের আন্দোলন বা নির্দিষ্ট একটা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মতো বড় ধরনের প্রবণতা বলা যেতে পারে। ভিত্তিভূমিটি যে সক্রিয়ভাবেই জোড়ালো হয়েছিলো সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। অগ্রবর্তীদের দ্বিধা-দ্বৈততা তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন, যে কারণে বিষয়টি তাদের মধ্যে আর সমস্যা আক্রান্ততায় স্থবির থাকেনি। ছোটকাগজের গোষ্ঠিবদ্ধতায় নিজেদের লেখালেখির চর্চা চালিয়েও তেমন কোনো বিতর্ক বা সমালোচনায় তাঁদের পড়তে হয়নি। এটা তাঁরা নিজেদের সমন্বিত মহিমাগুণেই করতে পেরেছিলেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আজও অটুট আছে, এই সময় যে প্রাপ্তি বা প্রত্যাশায় বিশেষ কোনো ফলযোগ হবে না ততধিক হতাশার উদ্রেক ছাড়া।
ইদানিং ছোটকাগজ নিয়ে বাংলাদেশে নানা ধরনের তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ছোট্ট এই মুভমেন্টটিও হুমকিসরূপ দেখছেন অনেকেই। কেউ কেউ ছোটকাগজ প্রকাশনাটাকে ভাবছেন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অন্যতম পথ, কেউ কেউ ভাবছেন দৈনিকের সাহিত্য পাতার প্রতিপক্ষ, কেউ কেউ ভাবছেন নিজেদের এক্সট্রা গুরুত্ব তৈরি করার প্রধান পথ, কেউ কেউ ভাবছেন নতুন লেখক বা যাদের লেখা কোথাও ছাপাবার উপযুক্ত নয় তারাই শেষমেশ ছোটকাগজ-কে আঁকড়ে ধরে জীবন রা করার প্রধানতম প্লাটফর্ম করে নিচ্ছেন, জীবন-জীবিকায় সামান্যতম অর্থযোগের ব্যবসায়িক প্রবণতাটিও বাদ যাচ্ছে না। যে যাই বলুন না কেন, সাহিত্যচিন্তায় আমাদের বর্তমান বঙ্গদেশে এমন কোন প্রতিষ্ঠান, এমন কোন দৈনিক নেই যাকে প্রতিপক্ষ ভেবে এই ভূ-খণ্ডে সাহিত্য আন্দোলনের নামে ছোটকাগজ প্রকাশনা হতে পারে। যারা এই বিষয়গুলো কেন্দ্র করে ছোটকাগজের শ্লোগান তোলেন তারাই শেষপর্যন্ত সত্ ছোটকাগজ কর্মী হয়ে ওঠেন না বরং ছোটকাগজ কথাটির মধ্যে অন্য কিছু লুকিয়ে রয়েছে। যে নামটি শুনলেই মনে হতে পারে সত যুক্তিসংগত-সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু কোনো, যেখান থেকে যে কেউ নির্দ্বিধায় তন্ময় হতে পারেন। আর বাদবাকি- বাজারে যেসব ধারণার প্রচলন করা হয় তাদের অনেকেই পাশ্চাত্যের ধারণা বা পশ্চিমবঙ্গের ছোটকাগজ আন্দোলনের মতাদর্শ নিয়ে হৈচৈ করে নিজেদের স্বকিয়তা হারাচ্ছেন। তাছাড়া ছোটকাগজও তো একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। দ্বিমত হবার সুযোগ নেই। আমি বিশ্বাস করি, যুক্তিসংগত এবং সত সাহিত্যের চর্চার পাশাপাশি নতুন লেখকদের সাহিত্যিক প্রবণতায় দাঁড়াবার একটা নির্দিষ্ট জায়গা করে দেয়া এবং নির্দিষ্ট একটা গোষ্ঠি তৈরি করা, যাতে অসত এবং অযৌক্তিক সাহিত্যের দিকে কেউ যেতে না শিখে। আর ঐ নির্দিষ্ট কাগজটি যা নিজেদের ভাবনাগুলি স্বকিয়তার সাথে গুরুত্ব প্রদান করবে, নিজেদের আরো গুরুত্বের দিকে ধাবিত করার প্রেরণা যোগাবে। সম্প্র্রতি ছোটকাগজের এই গুণটি বর্ধিত হতে চলেছে। সুষ্ঠু বিপণনের প্রত্যাশায় অমর একুশে বইমেলায় এখন লিটল ম্যাগাজিন চত্বরও দেয়া হয়ে থাকে। এর আগে আমরা দেখেছি, খোলা আকাশের নিচে বয়ড়াতলায় ছোটকাগজ কর্মীদের সেকি দুর্ভোগ! অথচ এই ছোটকাগজ করতে গিয়ে কোনো কোনো সম্পাদক/প্রকাশক নিজেদের রক্তও বিক্রি করেছেন ব্লাডব্যাংকে। সেটি সফল হয়েছে, কিন্তু ছোটকাগজের প্রকৃত সাহিত্য প্রবণতা কি আইডেন্টিফাইড হয়েছে? ছোটকাগজের প্রকৃত কর্মী হিসেবে আমরা যাদের জেনেছি তাদেরই কেউ কেউ ছোটকাগজের প্লাটফর্মটি ব্যবহার করে অন্য অভিধায় উচ্চ শিখরে অবস্থান করেছেন। যুক্তি থাকতে পারে, চেতনার কোনো পরিবর্তন সেখানে হয়নি। কিন্তু মৌলদৃষ্টিতে সার্বিক ছোটকাগজের ক্ষতিই হয়েছে।
নব্বই দশকে যদিও সেরকম কোন উল্লেখযোগ্য ছোটকাগজ খুঁজে পাওয়া যায় না, তবুও আশির দশকের ছোটকাগজ আন্দোলনের প্রভাব পুরোপুরি নব্বই দশকেই বিস্তারিত হয়। নতুন উদ্যোমি আরও লেখক-কর্মী এসে বিষয়টি আরো সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যান কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই দশকের নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য না থাকায় এই সময়ের লেখক-কবিকুল বিচ্ছিন্নভাবে অনেক পথেই হেঁটেছেন এবং হাঁটছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমি বলবো, নব্বইয়ে ছোটকাগজের সাহিত্যকীর্তি এলেন গীন্সবার্গীয় বা বিটলস্ ম্যানিয়ায় আক্রান্ত হয়ে একেবারে বিগড়ে গেছে। নব্বই দশকের ছোট আকৃতির কাগজের কথা বললে, বলা যাবে অনেক কাগজের কথাই কিন্তু চরিত্রগত এবং গুরুত্বের দিক থেকে দ্রষ্টব্য, ফৃ স্কুল স্ট্রিট, সূচক, উটপাখি, সাঁতার, মঙ্গলসন্ধ্যা, চালচিত্র, পত্তর, আড্ডারু, মন্ত্র, নন্দন, ছাপাখানা, ডামি এডিশান, আবৃত্তিলোক, উত্তর আধুনিক, লিরিক, সমুজ্জ্বল সুবাতাস, জীবনানন্দ, অণৃন্য, কারুজ, মেঘ, অঞ্জলি লহ মোর, মস্তক, অনুধ্যান, অক্ষর, ধাবমান, ছাট কাগজের মলাট, কফিন টেক্সট, বিকাশ, বালুচর, পথিক, কালোকাগজ, এইতো এখানে এমন, রা, জলদ, বিবিধ, পুষ্পকরথ, ক্যাথারসিস, সুমেশ্বরী, নিরন্তর, শিকড়, ঝড়, মান্দার এইসব ছোটকাগজের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় ইহা অতি ব্যাপক নয়, এছাড়াও উল্লেখ করা যেতে পারে নব্বই দশকের প্রধানতম ছোটকাগজগুলো এখন অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে।
এই দশকেও ছোটকাগজ কেন্দ্রিক উল্লেখযোগ্য কিছুসংখ্যক লেখক বেরিয়ে আসেন। মুজিব মেহদী, রাজীব নূর, ব্রাত্য রাইসু, মাহবুব কবির, কামরুজ্জামান কামু, মোস্তাক আহমাদ দীন, শাহেদ শাফায়েত, শিবলী মোকতাদির, আহমেদ নকীব, শোয়াইব জিবরান, রোকন রহমান, আহমদ মিনহাজ, রবিউল করিম, জহির হাসান, আশিক আকবর, মাহবুব মোর্শেদ, জেসমিন মুননী, জাকির তালুকদার, শুভাশিস সিনহা, সুহৃদ শহীদুল্লা, আহমাদ মোস্তফা কামাল, অদিত্ব শাপলা, রহমান হেনরী, নজরুল কবীর, ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ, হেনরী স্বপন, পাপড়ি রহমান, ফারক ওয়াসিফ, সাখাওয়াত টিপু, সাইম রানা, সরোজ মোস্তফা, রওশন ঝুনু, মাসুদার রহমান, গাজী মোবারক, রায়হান রাইন, নভেরা হোসেন, মিজান মল্লিক, প্রিসিলা রাজ, মাতিয়ার রাফায়েল, মাসুদ সেজান, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, অদিতি ফাল্গুনী, মজনু শাহ, বায়েজীদ মাহবুব, জাফর আহমদ রাশেদ, আশরাফ রোকন, আলফ্রেড খোকন, অরূপ রাহী, শতাব্দী কাদের, শামীমুল হক শামীম, টোকন ঠাকুর, মাসুদুল হক, আমীর খসরু স্বপন, আয়শা ঝর্না, সরকার আমিন, শাহেদ কায়েস, মির্জা তাহের জামিল, রাজা সহিদুল আসলাম, শরীফ শাহরিয়ার, মশিউর রহমান খান, শরীফা বুলবুল, শাহনাজ মুন্নী, সাইমন জাকারিয়া, শামীম রেজা, আকরাম খান, তুষার গায়েন, ইভানা ইলিয়াস, তানভীর আহমেদ সিডনী, ফাহমিদুল হক, সরসিজ আলীম, পলল পরাগ, মাসুদ আশরাফ, ওবায়েদ আকাশ, পলাশ দত্ত, জাহানারা পারভীন, চন্দন সাহা রায়, রাজীব আর্জুনি, বদরে মুনীর, তারেক মাহমুদ, বায়তুল্লাহ কাদেরী, মারুফুল আলম, রাদ আহমেদ, বিল্লাল মেহদী, কাজল কানন, অনিন্দ্য জসীম, খলিল মজিদ, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, ইমরুল হাসান এঁরাই মূলত নব্বই দশকের প্রথম সারির মসিয়ে।
দশক বিবেচনা যেকোন কাজে মঙ্গলের পাশাপাশি কিছু অমঙ্গলকর দিকও পরিলতি হয়। বর্তমান রচনাতেও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। আশির দশকে ছোটকাগজ প্রকাশনা জোরালোভাবে শরু হলেও কিছু কিছু কাগজ পূর্ণতা পায় নব্বই দশকে এসে এবং নব্বইয়ের চিহ্নিত প্রায় অধিকাংশ লেখকদের অংশগ্রহণসহ প্রকাশিত হয় আবার নব্বই দশকেও এমন কিছু ছোটকাগজ প্রকাশনা হয় যার সূত্রাসূত্র এবং কর্মীও মূলত আশির দশকের কিংবা তার কাছাকাছি সময়ের এবং তাতে নব্বইয়ের লেখকদের অংশগ্রহণের পাশাপাশি আশির দশকের লেখকদের অংশগ্রহণও পরিলক্ষিত হয় ফলে আলাদা করে দুটি দশককে না দেখাই বরং ভালো। তাছাড়া প্রসঙ্গটি যেহেতু ছোটকাগজ কাজেই কোন দশকে কত প্রগাঢ়ভাবে কাগজ প্রকাশিত হলো এ বিষয়টি লেখকদের সাথে সম্পৃক্ত নয়।
বহুদিন যাবত আমাদের ছোটকাগজের সাহিত্যমান একই বৃত্তের মনে হচ্ছে কিংবা একটি কাগজের প্রকাশনার সাথে অন্য আরেকটি কাগজের চিন্তা-চেতনা বা ভাবগত দিকে প্রায় কাছাকাছি সম্পর্ক দেখা যায়। তাছাড়া এই সময়ের ছোটকাগজে বিশেষ কোনো নিরীক্ষণ নেই। যেহেতু আমাদের দেশে ছোটকাগজ প্রকাশনার রীতি আছে আছে সেই ধারাবাহিকতা রা করেই কিছুসংখ্যক কাগজ প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে কোনোকিছুই নয় সে অর্থে ছোটকাগজও যে একটি প্রতিষ্ঠান সেটিও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং যেসব বিষয় ভাবা যেত, নানা দেশের সাহিত্যমাত্রিক সমন্বয়সহ আমাদের দেশেই রাস্ট্রিয় পলিসি লেভেলে ছোটকাগজের সাহিত্য প্রবণতার যথার্থ গুরুত্ব তৈরি করা। কাজেই সাম্প্রতিক ছোটকাগজ প্রকাশনা বিষয়ে আমি মনে করি, ছোটকাগজের এইসব দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি এবং, ছোটকাগজের সম্পৃক্ততা রয়েছে এরকম অন্যান্য বিষয়গুলোও নতুন করে ভাবা দরকার। এর মধ্যেই শুরু হলো একটি নতুন শতাব্দীর পথচলা। আমাদের সামনে এখন একটি নতুন দশক, নতুন শতক যার শুরুর কাল এখনই। ছোটকাগজ প্রকাশনা যেহেতু সারাবিশ্বেই প্রচলিত এবং ছোটকাগজ ঘিরে অসংখ্য তরুণের আবির্ভাব ঘটে কাজেই সমাগত আগামীর সময়ে ছোটকাগজ থেকে নতুন কিছু পাওয়া আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। অনেক তথ্য প্রযুক্তি আমাদের সামনে উন্মোচিত হবার অপেক্ষায়। আমাদের বিগত শতাব্দীর সমস্ত সাহিত্যের ধ্যান-ধারণা পাল্টে দিয়ে নতুন কর্মী, নতুন ছোটকাগজ, নতুন সাহিত্য দৃষ্টিগত হওয়াও কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা হবে না। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ওয়েব সার্চ ইঞ্জিন গোগুল ব্যবহারসহ আমরা খুব কাছাকাছি এসেছি ফেসবুক, গুড রিডস্-এর অনেক প্রোফাইল বা গ্রুপস্ ইমেইল ব্যবহারকারীদের। বাংলাভাষায়ও সংযোজিত হয়েছে আভাস, সাম হোআর ইন ব্লগ, সচলায়তন, কবিসভা, মতামত, মুক্তমনা, দরিদ্র ডটকম, বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম-এর আর্টস্সহ... জাতিয় দৈনিকের বেশ কয়েকটি ওয়েব সংস্করণ। প্রিন্ট ম্যাটারের সম্পৃক্ততা নেই এরকম সাহিত্যও এখন প্রায় ব্যাক্তি উদ্যোগে অহরহ প্রকাশিত হচ্ছে। ছোটকাগজ বা ছোট ওয়েব যাই হোক কথা হচ্ছে, এখনকার ছোট উদ্যোগের সাহিত্যমাত্রিক বিবেচনাও হওয়া উচিত আরো বেশি মেটাল-ডাইনামিক। যেমন আমরা ভাবতে পারি এই মেগাসিটি ঢাকার আকাশেও আরেকটি স্যাটেলাইট মেগাসিটি ঢাকা’র পরিবেশ, প্রতিবেশ। ভাবতে পারি, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছড়া, চিত্রকলা, নৃত্যকলা, নাট্যকর্ম, সংগীত, আলোকচিত্র ছোটকাগজ বা ছোট উদ্যোগের উপস্থাপন কর্ম আর যত যাই হোক না কেন নতুন সময়কে সামনে রেখেই বর্তমান ছোট উদ্যোগের সাহিত্য হওয়া উচিত। যাকে লক্ষ রেখে, এই শতকের শুরুর কাগজ তথা ওয়েব সাহিত্যের চলা শুরু হতে পারে। আশি এবং নব্বইয়ের ধারাবাহিকতা রা করেই শূন্যের প্রণোদনা প্রায় সমাপ্তির পথে। হতে পারতো বিশেষ বিশেষ সন্দর্শন, পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠতে পারতো কিছুসংখ্যক কবি-লেখকের নিজস্ব সাহিত্য ভাষা কিংবা টোটাল সময়ের সাহিত্যভাষাও। কিন্তু সার্বিকবিচারে এই দশক থেকেও আমরা বিশেষ কিছু পেয়েছি কিনা সে বিষয়ে আমার পর্যাপ্ত সন্দেহ আছে। শুধুমাত্র সন্দেহ নয় আমি বলবো, শূন্যের কবি-লেখকরা পুরো দশকটাই গোল্লায় শ্রম দিয়েছেন। একটি দশকের সাহিত্যকীর্তি যেরকম অর্জিত হতে পারে সে অর্থে এই দশকের সাহিত্যিক ধারণা তো বটেই, ছোটকাগজের ধারণাটিও এখানে প্রায় অর্বাচীন। এটা বিষ্ময়কর যে, ছোটকাগজই বলি বা ছোট আকৃতির কাগজই বলি এই দশকে ব্যাপক হারে কাগজ প্রকাশিত হয়েছে। কয়েকটি কাগজের নাম উল্লেখ করছি খতিয়ে দেখতে পারেন, শূন্যের কবি-লেখক ছোটকাগজ কর্মীদের সংযোজন, এগুলোর সাফল্য কিংবা সম্ভাবনাই বা কতদূর... ব্যাস, লোক, হাওড়, উল্লেখ, একুশের সংকলন, পথরেখা, ব্রাত্য, শালুক, কাশপাতা, দ্রাঘিমা, সমগীত, অমিত্রাক্ষর, শিরদাঁড়া, সুনৃত, কোমল গান্ধার, পর্ব, আরণ্যক, অর্কিড, শব্দপাঠ, দূর্বা, সূর্যঘড়ি, দুয়েন্দে, অথবা সুর্মারঙ, কহন, কাকতাড়ুয়া, পুণ্ড্র, করুল, বোধ, ক্রান্তিক, থিয়েটারওয়ালা, উলুখাগড়া, লেখাবিল, মুক্তক, গুহাচিত্র, ময়মনসিংহ জং, নান্দীপাঠ, কবিতামঞ্চ, কথা, কবিতা সংক্রান্তি, কালনেত্র, সাচি, ঘুড়ি, নাটাই, ছান্দস, সুবিল, কালসুদ্ধি, অরণি, সময়কাল, বনপাংশুল, ০ মাতাল, হরমা, সাম্প্রতিক, মুনাজেরা, নন্দিতা, জ্যোতি, মাওরুম, মৃদুশব্দ, কুঁড়েঘর, ডুমুর, কবিতাপত্র, কাঁদাখোঁচা, চরাচর, সহজ, হালখাতা, থার্ডম্যাগ, দ্বিতীয়বার, বাংলা জার্নাল, দাহপত্র, দোঁয়াশ, নাটোর, বৃত্তালোক, মরাল, ধূলিচিত্র, বাবুই, জলটুঙি, ছায়া, চারবাক, পড়শি, শিল্প সাহিত্য, আলোকপত্র, পোয়েট-ট্রি, বৈঠা, ব্রতকথা, ছায়াবৃত্ত, লাল ইশতেহার, কালিদহ, জাঙ্গাল, যাত্রী, বেহুলা বাংলা, পানসি, ভূ’লুয়া, জিজ্ঞাসু, শ্রুতি, সংশপ্তক, ধানসিঁড়ি, কালস্রোত, প্রতিবুদ্ধিজীবী, শূন্য, নাইল্যাকাডা, অরিত্র, উতঙ্ক, ময়ূখ, কর্ষণ, নাম, অত্রি, অদ্বৈত, তৃণযোগ, অতঃপর, নতুন দিগন্ত, পুনশ্চ, বৃত্তালোক, বিভাস, হাঁটুজল, রোদ্দুর, ইস্টিশন, নীলঘুড়ি, নতুন কণ্ঠস্বর, নীহারিকা, ধলাই, অর্ক, দ্বৈত, সহজিয়া, গন্দম, অরিন্দম, একুশ শতকের স্রোত, অনুঘটক, শালিক জংশন, লাস্টবেঞ্চ ১১৫, বিজ্ঞান চেতনা, বাউলা, সুতরাং, সেন্ট্রাল জেল, বুক রিভিউ, ইক্ষণ, উৎপথ, পথিকৃৎ, গণমুক্তি, ছড়াপত্র, রেলগাছ, জারুল, মেইন রোড, নহলী, অপর, পরশ, দূত, টোঙ, ধমনি, চন্দ্রাবতী, প্রেক্ষণ, শব্দসাঁকো, সম্প্রীতি, প্রাঙ্গণ, ক্রিটিক, বাতিঘর, অর্জন, শতদ্রু, আর্টবিট, ঢোলসমুদ্দুর, গৌড়জন, হার্ডব্রেক, জেব্রা, বউ, অক্টোপাস, রাফ, দাঁড়কাক, আদিবাস।

http://haor-2.blogspot.com/2009/06/blog-post_03.html

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন